‘বাসায় রুমের মধ্যে একটা মাইক্রোফোন ছিল, সেটা দিয়েই গান রেকর্ড করতাম। আগে কোনো মাইকও ছিল না। হাতের কাছে যা আছে, সেটা দিয়েই কাজ করছি,’ বলছিলেন কাকতালের ভোকালিস্ট আসিফ ইকবাল অন্তু। এসব গানই ইউটিউবে প্রকাশ করে পরিচিতি পেয়েছেন অন্তু। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে তাঁর ব্যান্ড কাকতাল।
বললেন, ‘যখন দেখছি, সেগুলোই মানুষ শুনছে, ভালোবাসছে, তখন তো আমাদের আর প্রচলিত নিয়মে যাওয়ার কোনো মানেই নেই।’ ইউটিউব ছাপিয়ে এখন নিয়মিত কনসার্ট করছে কাকতাল।
ইউটিউবের পাশাপাশি স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম স্বাধীন সংগীতশিল্পীদের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
একসময় গান প্রকাশের জন্য রেকর্ড লেবেলের মুখাপেক্ষী থাকতেন তরুণ শিল্পীরা, কখনো কখনো স্পনসরের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হতো। প্রযুক্তির কল্যাণে এসব ছাড়াই এখন নিজেদের প্রকাশ করতে পারছেন তরুণ শিল্পীরা। ইউটিউবের পাশাপাশি স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিকের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম স্বাধীন সংগীতশিল্পীদের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাই গান প্রকাশের প্রথাগত নিয়মের বেড়াজালে আর আটকে থাকতে চান না শিল্পীরা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘চলো ভুলে যাই’ গান গেয়ে পরিচিতি পাওয়া তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীনও স্বাধীন সংগীতশিল্পী। অনেকটা শখের বশে ২০১৮ সালে ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন। ছয় বছর ধরে মৌলিক গানের পাশাপাশি গান কাভারও করছেন তিনি। পারশা বলেন, ‘আমি শুরু থেকে একাই গান করছি। ওই সময় আমি একদম নতুন, আমাকে কেই–ই বা সহযোগিতা করবে। এসবে অনেক বেশি লবিং দরকার হয়, আমার কিছুই ছিল না। ভাবলাম, নিজে থেকেই শুরু করি।’
বাসায় বসে গান করতেন, কোভিডের মধ্যে পারশার গান শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। তবে খুব বেশি শ্রোতাদের মাঝে পরিচিতি ছিল না। এই বছর ‘চলো ভুলে যাই’ গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি। খালি গলায় গাওয়া গানটি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন পারশা।
প্রায় এক দশকের ক্যারিয়ারে কোনো রেকর্ড লেবেলের সঙ্গে গান করেননি সংগীতশিল্পী আহমেদ হাসান সানি। ‘শহরের দুইটা গান’, ‘মানুষ কেন এ রকম’–এর মতো আলোচিত গানের এই শিল্পী বেশির ভাগ গান নিজেই প্রকাশ করেছেন।
তাঁরা ছাড়াও আসির আরমান, তানভীর ইভান, ঈশান মজুমদার, মাশা ইসলাম, সোহান আলী, ঈশান মজুমদারসহ আরও অনেকে স্বাধীনভাবে গান করছেন।
কতটা সম্ভাবনা
‘একসময় গান প্রকাশের জন্য শিল্পীদের রেকর্ড লেবেলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। তবে এখন মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না। শিল্পীরা নিজেরাই গান রেকর্ড করে প্রকাশ করতে পারেন,’ বলছিলেন সংগীতশিল্পী আহমেদ হাসান সানি।
একসময় ঢাকার সংগীত মূলত রেকর্ড লেবেলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। গানের অ্যালবামও শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। রেকর্ড লেবেলের সেই সুদিন আর নেই। প্রযুক্তির উত্থানে গান এখন হাতের মুঠোয়। চাইলেই যেকোনো শিল্পী গান রেকর্ড করে ইউটিউব, স্পটিফাইয়ে প্রকাশ করতে পারেন।
সানি বলছেন, অনেক রেকর্ড লেবেল শিল্পীদের প্রাপ্য রয়্যালটি শোধ করতে চান না। ইউটিউব ও স্পটিফাই থেকে কোনো মাধ্যম ছাড়াই শিল্পীরা সরাসরি অর্থ পান। এটি তরুণ ও স্বাধীন শিল্পীদের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
বাইরে ডিজিটাল মাধ্যমে স্বাধীন শিল্পীদের গান প্রকাশের চল বেশ পুরোনো। তবে দেশে এই ঢেউ অনেক পরে লেগেছে। ‘নরম কোমল দিলরুবা’, ‘একা বেঁচে থাকতে শেখো প্রিয়’ গানের শিল্পী আসির আরমান বলছেন, ২০১৫ সাল থেকে এই চলটা দেখছেন তিনি। পরে তিনিও ইউটিউবে গান প্রকাশ শুরু করেছেন।
সংগীত–গবেষক গৌতম কে শুভ বলছেন, রেকর্ড লেবেলের বাইরে ডিজিটাল মাধ্যমে গান করেই স্বাধীন শিল্পীরা পরিচিতি পাচ্ছেন। এসব শিল্পীর অনেকে নিয়মিত কনসার্টও করছেন। এটি খুবই ইতিবাচক বিষয়। ২০২০ সালের পর থেকে ইউটিউবে গান প্রকাশের চলটা আরও বেড়েছে বলে মনে করেন গৌতম কে শুভ।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করলে গানের নিরাপত্তাও অটুট থাকে। লাইসেন্স করে কোনো গান প্রকাশ করলে অন্য কেউ গানের অপব্যবহার করতে পারেন না। সংগীতশিল্পী আসির আরমান বলছেন, ‘লাইসেন্স করে প্রকাশ করলে গানটা অন্য কেউ নিজের নামে চালাতে পারবে না। গানের নিয়ন্ত্রণটা নিজের কাছেই থাকে।’
বিভিন্ন লাইসেন্সিং প্ল্যাটফর্মে লাইসেন্স করা যায়। এদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যম স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিকসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে একযোগে গান প্রকাশ করা যায়।