গায়ক আকবর
গায়ক আকবর

আকবরের মৃত্যুর পর কেমন আছে স্ত্রী ও মেয়ে

শূন্য থেকে তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন গায়ক আকবর। আবার জটিল-কঠিন রোগে ভুগতে ভুগতে একসময় নিঃস্ব হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায়ও নেন। রেখে গেছেন স্ত্রী-সন্তান। ঢাকার মিরপুরে মেয়ে অথৈকে নিয়ে থাকেন স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। গেল বছরের নভেম্বরে আকবরের মৃত্যুর পর মেয়ে আর স্ত্রীর প্রথম ঈদ। সবার জীবনে ঈদের আনন্দ কমবেশি হলেও এই পরিবারে যেন কোনো আনন্দ নেই। একেবারে বর্ণহীন। তাই তো মেয়ে অথৈ বাবার কথা মনে করে কাঁদে। স্ত্রী কানিজ ফাতেমাও আজ শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘অথৈর বাবা মারা যাওয়ার পর আমার কিছুই মনে থাকে না। কিছু করব, মেন্টালি সেটআপও হতে পারছি না। ওর বাবাকে ভুলতেই পারি না। (কান্না)। খালি মনে হয়, অসুস্থ ছিল, বিছানায় শুয়ে থাকত, তা-ও তো চোখের সামনে একজন গার্ডিয়ান ছিল। কষ্টটা হচ্ছে, কাছের মানুষটাই হারাই ফেলছি, এটাই এখন বড় কষ্ট। ’

মৃত্যুর আগে পরিবার নিয়ে গায়ক আকবর ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বরে দুই কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। মেয়ে অথৈ ও তার মা এখনো সেই বাড়িটিতেই থাকেন। একমাত্র আয় করা মানুষটি না থাকায় খরচ কমাতে একটি কক্ষ সাবলেট দিয়ে দিয়েছেন।

এতে ১৫ হাজার টাকার বাসা ভাড়া এখন পড়ে সাড়ে ৮ হাজার টাকা। আকবরের অসুস্থতার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য ২০ লাখ টাকা অনুদান দেন। সেই টাকার মুনাফা হিসেবে ৩ মাস পরপর ৪৯ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তুলতেন আকবর। ওই টাকার ১৬ হাজার ৩০০ টাকায় মেয়ের পড়াশোনা, বাসাভাড়া ও সংসার চলে।

গায়ক আকবর

কানিজ ফাতেমা জানালেন, আগে দুই রুমের বাসা ছিল। অথৈর বাবার এক রুম সাবলেট দিয়েছি। একটু সেভ হয়েছে। এদিকে অথৈর বাবার মৃত্যুর পর মেয়ের বেতন স্কুল থেকে পুরোপুরি ফ্রি করে দিয়েছে। কলেজ পর্যন্ত ওর আর এখন কোনো বেতন লাগবে না। প্রিন্সিপাল এটা নিজে থেকেই করে দিয়েছেন। শুধু দুই বিষয়ের প্রাইভেট পড়ার জন্য তিন হাজার টাকা লাগে। অন্যদিকে অথৈ গান শিখত সুজিত মোস্তাফা স্যারের কাছে। আকবরের মৃত্যুর পর তিনিও কোনো বেতন নেন না। তিনি বলেছেন, ‘তোর মেয়ের দায়িত্ব আমার। কীভাবে কী করতে হবে, সেটা আমি বুঝব। আকবর আমার হাতে ওরে দিয়ে গেছে।’

স্কুলের বেতন ও গানের তালিম নেওয়ার জন্য আপাতত কোনো টাকা খরচ হচ্ছে না ভেবে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও কানিজ ফাতেমা ভালো নেই। বললেন, ‘মেয়েটা সব সময় ওর বাবাকে খোঁজে। বাবার কথা বলে কান্নাকাটি করে। আজও সকাল থেকেই খুব কান্নাকাটি করছিল। বাবা ছাড়া ঈদ, এটা যেন ভাবতেই পারছে না। গত বছর তো পায়ের অপারেশনের জন্য আড়াই মাস পিজিতে ছিল। ঈদের ঠিক দুই দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে বাসায় রিলিজ দিয়ে দিছিল। বাসায় এসে তো দু-তিন মাস ভালো ছিল। তাও তো বাসায় ছিল। এবার তো চোখের সামনে নেই।’

স্ত্রীর সঙ্গে আকবর

কিশোর কুমারের গাওয়া ‘একদিন পাখি উড়ে যাবে’ গানটি নতুন করে গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন আকবর। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে সেই গান প্রচারের পর রাতারাতিই বদলে যায় তাঁর জীবন। যশোরের রিকশাচালক আকবর হয়ে ওঠেন দেশের সবার কাছে গায়ক আকবর। ইত্যাদি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হানিফ সংকেত আকবরের পরিবারের খোঁজখবর রাখেন। কদিন আগেও ফোন করে টাকা দিয়েছেন বলে জানালেন কানিজ ফাতেমা। বললেন, ‘এখন তো ওর বাবা নেই। এখন কাউকে ফোন দিতে কেমন জানি লাগে। আনইজি লাগে। কারণ, সবাইকে আগে তো অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। স্যারকেও (হানিফ সংকেত) খুব একটা ফোন দিই না। কিছুদিন আগে স্যার নিজেই ফোন দিয়েছেন। বলেছেন, কীরে ফোনটোন দিস না। আমি বলছি, স্যার আমার লজ্জা লাগে। আগে তো অনেক জ্বালাইছি। পরে বলছে, মেয়ের কী অবস্থা? এরপর টাকা পাঠাইছে। বলেন, মেয়ের জামাকাপড় কিনিস। বাজারসদাই করিস। এরপর কদিন আগে আবার ফোন দিয়েছেন, জানতে চেয়েছেন, কী রে, জামাকাপড় কিনছিস তো? বাজার করছিস তো?’

কানিজ ফাতেমা জানালেন, আগে যেভাবে অনেকে খোঁজ নিতেন, এখন সেভাবে খোঁজ কেউ নেন না। তারপরও দু-একজন আছেন। তাঁদের মধ্যে আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রহমান। বললেন, ‘আমেরিকায় একজন ভাই আছেন, রহমান ভাই, তিনি আকবরের অসুস্থতার সময়েও অনেক হেল্প করেছিলেন। ফোন দিলে মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করেন। আকবরের মৃত্যুর পর এ-ও বলেছেন, যখন সমস্যায় পড়বা, তখন আমাকে বইলো।’
আকবরের মৃত্যুর খবর পেয়ে খল অভিনেতা ডিপজলও এই পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময়টায় পাঁচ-ছয় মাসের বাসাভাড়া বকেয়া তিনি পরিশোধ করেন বলেও জানালেন কানিজ ফাতেমা। বলেন, ‘ডিপজল তখন বলেছিলেন, কোনো সমস্যা হইলে আমারে ফোন দিস।’ কিন্তু এখন কাউকে ফোন দিতে লজ্জা লাগে। কানিজ ফাতেমা বললেন, ‘অর্থকষ্ট তো আগেও করছি, তখন তো কষ্ট মনে হইত না। মানুষটা তো সাথে ছিল। এখন তো নেই। তাই বলি, কষ্ট তো আমাদের নতুন না। সাত বছর ধরেই করি। তখন তো ওর আব্বু ছিল। কষ্ট কষ্ট মনে হতো না। দিন শেষে বাসায় এলে তো দেখতে পেতাম, শুয়ে আছে, না হয় হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়ের খোঁজখবর রাখত। যেখান থেকেই হোক, সংসার কিন্তু ঠিকই চালাইছে। কষ্ট হইছে, তারপরও কিন্তু সংসার ঠিকই চালাইছে। এখন তো আজীবনের মতো হারাই গেছে।’ (কান্না) এবারের ঈদে ঢাকায় থাকা হবে আকবরের স্ত্রী ও তাঁর মেয়ের। কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। কথায় কথায় কারণ হিসেবে কানিজ ফাতেমা বললেন, ‘আকবরের মৃত্যুর পর অথৈর দাদিবাড়ি থেকে কেউ যোগাযোগ করে না। আর আমার বাড়িতে তো আকবরের সঙ্গে বিয়ের পর সম্পর্ক নেই, সেই ১৫ বছর।’