আলীম তার বাবা হাবিবকেও ছাড়িয়ে যাবে: ফেরদৌস ওয়াহিদ

গায়কির পাশাপাশি সংগীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ তাঁর স্টাইলেও মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। এই পপ তারকার আজ জন্মদিন। দিনটি উপলক্ষে ‘জীবনগল্প’ নামে একটি গান প্রকাশিত হয়েছে। শেখ নজরুলের লেখা গানটির সুর করেছেন পিজিত মহাজন। এর বাইরে কাজ চলছে আরও ২০টি গানের। এদিকে চ্যানেল আইয়ের জন্য তৈরি ঈদের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘এই দিন সেই দিন ঈদ আনন্দ’তে গান গেয়েছেন। জন্মদিন, নতুন গানসহ নানা প্রসঙ্গে গতকাল তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের
ফেরদৌস ওয়াহিদ
ছবি : প্রথম আলো
প্রশ্ন

‘জীবন গল্প’ গানের ভিডিওর শুরুতে ফেরদৌস ওয়াহিদের জীবনের গল্প বলা হচ্ছে। এটাই কি আপনার জীবন গল্প?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : এখন যে জীবনটা যাপন করছি, ‘জীবনগল্প’ গানে সেটাই উঠে এসেছে। তবে যা-ই যাপন করছি না কেন, আমার মনে হয় জীবনের সম্পূর্ণটাই আবেগ। এখানে বিবেক নিয়ে জোর খাটানোরও কিছু নেই। বিবেকের ব্যাপারটা মানুষের নিয়ন্ত্রণেও নেই, এটা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাকি জীবন যেটা দেখি, সেটা শুধুই মায়া-মমতা-আবেগ। একসময় সবই শেষ হবে।

প্রশ্ন

যে জীবন কাটিয়ে এসেছেন, তা নিয়ে আপনার কী মনে হয়?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : যে জীবন কাটিয়ে এসেছি, তা নিয়ে ভাবতেও আমার খুব ভালো লাগে। জন্মের পর থেকে তারুণ্য, কৈশোর, যৌবন, বিয়েশাদি, সন্তানাদি, পেশাগত পরিচিতি—সব মিলিয়ে যে জীবন, তা নিয়ে ভাবতে ভীষণ আনন্দ লাগে। আমি তো অনেক বছর ধরে বিক্রমপুরে গ্রামের বাড়িতে থাকি। পাশে নদী। যখন আমি নির্মল নদীর বিশালতায় থাকি, ধানখেতের মধ্যে হাঁটি—এসব ভাবতে খুবই ভালো লাগে। আজও এমন পরিবেশে ‘বন্ধু চিরকাল’ একটা গানের শুটিং করলাম।

প্রশ্ন

৭২ বছরের জীবনের কোন সময়টা সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ছিল বলে মনে করেন?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : পেশাজীবনটাই সবচেয়ে বর্ণাঢ্য। পেশার সময়টায় যতটা না তখন উপলব্ধি করতাম, এখন এসে তার চেয়ে বেশি করছি। আমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে, সব আবেগে, বিবেকের কোনো স্থানই সেখানে নেই।

ছেলে হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ
প্রশ্ন

আবেগের কারণে তো মানুষ ভুলও করে?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : আবেগে তো ভুল হবেই। ভুল হয় দেখেই তো সুখশান্তি আসে। ভুলের জন্য দুঃখটা আসে। দুঃখের পরই আবার সুখ। ভুল থেকে বের হওয়া তো সম্ভবও নয়। ভুলের কারণে আমার কোনো আক্ষেপও নেই।

প্রশ্ন

এখন যে জীবন কাটছে, তা নিয়ে উপলব্ধি কী?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : এখনকার জীবনটা অতীত ও বর্তমানের সমন্বয়ে নতুন ভাবনা। আমার মনে হয়, এই জীবনে ভালো কিছু একটা করে আসছি। দূর থেকেও তা দেখতে পাই। ভালো লাগে। এখন এসেও ২২টি গান তৈরি করছি। এসব গানের চিত্রনাট্য হচ্ছে। ফেলে আসা দিনটা না হলে আজকের দিনটা এভাবে উপভোগ করতে পারতাম না। জীবনের গল্পও বুঝে ফেলেছি। পেশাগত জীবন না থাকলে আজকের দিনের মর্মার্থই খুঁজে পেতাম না।

প্রশ্ন

জীবন নিয়ে কোনো আফসোস, আক্ষেপ তাহলে নেই?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : কখনোই নয়। আমি মনে করি না, এটা নিয়ে আক্ষেপ করার কিছু আছে। যা আমার জন্য নির্ধারিত, সেটাই হয়েছে, হচ্ছে। হবেই।

গানে গানে গুণীজন সংবর্ধনার মঞ্চে ছেলে হাবিবের সঙ্গে বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ
প্রশ্ন

আপনার গাওয়া ‘জীবনগল্প’ গানের সুরকার তরুণ গায়ক ও সংগীত পরিচালক পিজিত মহাজন। তিনি গানটির ভিডিওর নির্মাতাও। এমন তরুণে আস্থা খোঁজার কারণটা কী?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : আমি এককথায় বলব, পিজিত মহাজন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। একজন শিল্পী হিসেবে ওর মতো তরুণের মধ্যে যা পেয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি। সুর শোনার পর তো মনে হলো, ওর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। আমি হাবিব ছাড়া দু-একটি গান অন্যের সুরে গেয়েছি। ওসব সুরকারের আগ্রহে। কিন্তু এই প্রথম স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো সুরকারের কাছ থেকে গান চেয়েছি, আর তা পিজিতের কাছ থেকেই। আমি মনে করি, একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, সে কতটা ভালো মানুষ, আমি পিজিতের মধ্যে ভালো মানুষের সব গুণ পেয়েছি। এখানেই তো আবেগের খেলা। কেউ ভুল করে, কেউ ভুল করে না।

প্রশ্ন

জন্মিলে মরিতে হবে, এটাই চরম সত্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুভাবনা কি আপনাকে ভাবায়?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। বাস্তবতা। এটার নিয়ন্ত্রণ মানুষের মধ্যে নেই। মৃত্যুর ব্যাপারটা আমাকে সার্বক্ষণিক ভাবায়। যার কারণে পুরোপুরিভাবে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামীণ পরিবেশে চলে আসা। আমার তো আসলে যেতেই হবে। যেতেই যদি হয়, একটু পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য গ্রামটাকে বেছে নিই। ৪০ বছরের পর থেকে মৃত্যুভাবনা চলছে। প্রথম প্রথম তো একদিন পৃথিবীতে থাকব না ভাবলে অস্থির লাগত। এখন যেভাবে হোক, মনের ভেতরে একটা বিশ্বাস ঢুকে গেছে, আরেকটা পৃথিবী আছে। আমি এই পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীর দিকে যাচ্ছি, তাই এটা ভাবতে ভালোই লাগে। কোনো এক সময় ভয় লাগত।

প্রশ্ন

৪৯ বছরের সংগীতজীবনে যখন পেছনের দিকে তাকান, কী মনে হয়?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়া—এই নিয়েই তো মানুষের জীবন। যখন মানুষের ভালোবাসা আসে, সুখ অনুভব করি। তবে অল্প কথায় মনে হয়, চমকিত ভালোবাসার চাইতে সহজ-সরল প্রাপ্তির মধ্যে যারা আছে, তারাই ফেলে আসা জীবনকে অসাধারণভাবে উপভোগ করতে পারছে। সোজা কথা, একজন শিল্পীর জীবনে সবার স্বচ্ছন্দ ভালোবাসার চাইতে মূল্যবান আর কোনো কিছুই নেই। সংগীতজীবনের শুরুর দিকে অনেকে উৎসাহ দিয়েছেন, সেই স্মৃতি মনে পড়ে। পাশাপাশি যারা বলেছিল, আমাদের কারণে সংস্কৃতি রসাতলে গেছে, তাদের কথাও মনে পড়ে।

প্রশ্ন

আপনার চোখে বাংলাদেশের গানের অবস্থা এখন কেমন?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : আমার তো মনে হয় উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে। তবে একটু থমকে থমকে যাচ্ছে। কালো মেঘের মধ্যে বিজলিটা যেমন চমকায়, তেমনি গানের আকাশেও বিজলি চমকায়, আবার চলে যায়। স্থায়ী ও চমৎকার পরিবেশটা এখনো আসছে না। হয়তো আসবে। অনেক সম্ভাবনা আছে। রাতের পর দিন, দিনের পর আবার রাত—এভাবেই তো চলছে, চলবে। আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমরা দেখতে পারব কি না জানি না; তবে আমাদের টাকার হাতছানি থেকে সরে আসতে হবে। এটাও ঠিক যে আমাদের তরুণেরা ভালো করছে। ওদের বলতে চাই, তোমরা অনেক প্রতিভাবান। টাকার চেয়ে গানকে বেশি ভালোবাসো।

প্রশ্ন

সম্প্রতি দেখা গেল, একটি  অনুষ্ঠানে বাবা হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে একটি মঞ্চে আপনার নাতি আলীম ড্রামস বাজাচ্ছে। দাদা হিসেবে এটা আপনাকে কতটা গর্বিত করে?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : আমার তো মনে হয়, আলীম তার বাবা হাবিব ওয়াহদিকেও ছাড়িয়ে যাবে। আমি খুব বেশি গর্বিত। ভালো লাগে এসব ভাবতেও। আলীমের ড্রামস বাজানো তো মুগ্ধ করেছে। হাবিবের বেলায় যতটা না খুশি ছিলাম, আলীমের ব্যাপারে তার চেয়ে বেশি খুশি।

প্রশ্ন

ছেলে হাবিব ওয়াহিদ দেশের জনপ্রিয় একজন মিউজিশিয়ান। নাতির জীবনটা কীভাবে দেখতে চায় দাদা?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : ও যদি মিউজিশিয়ান হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার বিশ্বাস, হাবিবরা সংগীতাঙ্গনে যে অবস্থা পেয়েছে, আলীমরা আরও ভালো পাবে।

প্রশ্ন

ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘এই দিন সেই দিন ঈদ আনন্দ’তে গান করলেন?

ফেরদৌস ওয়াহিদ : অনেক দিন পর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গাইলাম। আয়োজনটা দারুণ ছিল। আমার গ্রামের বাড়িতে গানের ভিডিওর শুটিং হয়েছে।

ফেরদৌস ওয়াহিদ
প্রশ্ন

এবার জন্মদিন প্রসঙ্গ। শুভ জন্মদিন।

ফেরদৌস ওয়াহিদ : এই দিনে পৃথিবীতে এসেছি, ভাবতেই ভালো লাগে। সবচেয়ে বড় ভালো লাগা, আমার জন্ম ঢাকার গেন্ডারিয়াতে ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের বছর; তারিখটা ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস। একটা জন্মবছর, আরেকটা জন্মমাস। দুটি বিশেষ দিনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আমার আবেগটা জড়িয়ে আছে।