মাত্র ছয় লাইনে গান হয় নাকি! গানটিকে অ্যালবামে রাখতেই চাননি শিল্পী। সেই গান ‘কী ছিলে আমার বলো না তুমি’ শ্রোতারা লুফে নিল। রাত পোহানোর আগেই মনি কিশোরের নাম জেনে গেল গোটা দেশ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের এক গান তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল বাজারকাটতি অ্যালবামের শিল্পী হিসেবে। একে একে ৩০টির বেশি একক অ্যালবাম করে ফেললেন। তারপর একসময় অডিওজগতে ঘটল পালাবদল। এখন কোথাও মনি কিশোরের দেখা মেলে না।
কোথায় আছেন ‘উৎসব’, ‘এই তুমি সেই তুমি নেই তুমি’, ‘কী করে ভাবলে’, ‘আমাকে ভালোবাসা সে তোমার প্রথম ভুল’-এর মতো সফল অ্যালবামের শিল্পী? আছেন এই ঢাকা শহরেই। থাকেন বাসাবো এলাকায়। জড়িত আছেন কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে। অবশ্য ব্যবসাটাই বরাবর করেছেন। গানের জগতে আসার আগেও ব্যবসা করতেন। যখন ব্যস্ত শিল্পী ছিলেন, তখনো ব্যবসাটাকে ছাড়েননি। গানের সঙ্গে কি সব সম্পর্ক চুকে গেল?
মনি কিশোর জানালেন, ১০ থেকে ১২ বছর আগে শেষবারের মতো অ্যালবামে গেয়েছেন। টিভিতে ‘লাইভ’ গেয়েছেন সেটাও বছরখানেক হয়ে গেল। পেশাজীবীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে গাওয়ার ডাক আসে।
পুলিশ, কাস্টমস, পর্যটন—এ রকম পেশার মানুষের ঘরোয়া আসরে গাইতে যান। কনসার্ট তথা স্টেজ শোতে তাঁর যাওয়া হয় না। গান এখনো তাঁকে তাড়া করে ফেরে। টুকটাক গান ইউটিউবে ছাড়েন। চলতি বছরই এমন দু-একটি গান ইউটিউবে ছেড়েছেন। সেগুলো পুরোনো গান নয়, নতুন গানই গেয়েছেন।
আসলে এখনকার গানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারঙ্গম নন মনি কিশোর। তাঁর মতে, গান হয়ে গেছে দেখার বিষয়। তাঁদের সময়ে ছিল উল্টো। স্মৃতি হাতড়ালেন মনি কিশোর। ‘আমাদের সময়ে গানটা ছিল অদেখার প্রতি আকর্ষণ। ছিল অনুভব করার বিষয়। ঈদে একটা অ্যালবাম আসবে। ভক্তরা ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে খোঁজ নিতেন। ১৫ রোজা যায়, ২০ রোজা যায়। প্রতিদিন শ্রোতারা খবর নেন ক্যাসেট এসেছে কি না। আমরা আরামবাগে প্রেসে গিয়ে দেখতাম, অ্যালবামের পোস্টারটা কেমন হলো। গানের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। সন্ধ্যায় সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী মিলে আড্ডা দিতাম। সবাই বসে কেমন গান করব, কীভাবে করব—এসব নিয়ে কত কথা।’
মনি কিশোরের কথায়, এখন আর অডিও বলে কিছু নেই। অডিও গান কেউ আর শোনে না।
তিনি আরও বলেন, ‘একটা গান তৈরি করতে ২০ হাজার টাকা খরচ হলে মিউজিক ভিডিওতে খরচ হয় এক লাখ টাকা। গান কি গাজী মাজহারুল আনোয়ার লিখবে, নাকি মনিরুজ্জামান লিখবে, সেই আলোচনা নেই। কোন ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করবেন, কোথায় শুটিং করবেন, এসব আলোচনা।’ মিউজিক ভিডিওতে মুখ দেখাতে ভালো লাগে না মনি কিশোরের। স্টুডিওতে গাওয়ার দৃশ্যকে মিউজিক ভিডিওতে জুড়ে দিয়ে কোনোমতে স্রোতের সঙ্গে লেগে থাকেন। ‘পুরোপুরি গতানুগতিক হলেও আবার চলবে না। একেবারে তো উল্টো স্রোতে চলতে পারব না। সময়ের সঙ্গে একটু মানিয়ে নিতে হয়। এ জন্য স্টুডিও ভার্সনটা রাখি’, বললেন শিল্পী।
সংগীতে বিশাল ওলট–পালট হয়ে গেলেও মনি কিশোর এখনো শ্রোতাদের ভালোবাসায় ধন্য হোন। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা বললেন তিনি। ‘করোনার মধ্যে এক ত্রাণ বিতরণে গিয়েছি। সম্পর্কে বড় ভাই এক নেতার বাসায় বসেছি। ভাবি এসে বললেন, তোমার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা দেখা করবেন। ভদ্রমহিলা এলেন। পঁয়ত্রিশের বেশি বয়স হবে না। তিনি এসেই ভরা মজলিশে আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আরে, কী ব্যাপার। ভদ্রমহিলা বললেন, তিনি যখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়েন, তখন তাঁর বড় বোন আমার ক্যাসেট জোগাড় করে শুনতেন। তখন থেকে তাঁর ইচ্ছা জীবনে একবার আমাকে দেখবেন। তিনি শুনেছেন যে এলাকায় মনি কিশোর এসেছেন। তাই দেখতে এসেছেন।’ এসব ভালোবাসার জন্য শ্রোতাদের কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতা অনেক।
মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও, টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায়ও তেমন গাননি। মূলত, অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতৃপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তাঁরই সুর করা, তাঁরই লেখা। ২০টির মতো গান লিখেছেন ও সুর করেছেন মনি কিশোর।কথায় কথায় জানালেন, মনি কিশোর তাঁর পোশাকি নাম। প্রকৃত নাম মনি মণ্ডল। কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন বলে নামের সঙ্গে ‘কিশোর’ জুড়ে নিয়েছিলেন। ‘কুমার শানু নিয়েছেন “ওস্তাদের” নামের একাংশ। আমি নিয়েছি তাঁর নামের আরেক অংশ,’ হাসতে হাসতে বললেন মনি কিশোর।
(মাহফুজুর রহমানের লেখাটি পুনঃপ্রকাশ। এটি ২০২০ সালে প্রথম আলো বিনোদনে ছাপা হয়েছিল)