মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। ছবি: উইকিমিডিয়া
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। ছবি: উইকিমিডিয়া

গীতিকবিতার প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

আধুনিক বাংলা গানের জগতে জীবন্ত এক কিংবদন্তির নাম মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। কবিতা লিখতে লিখতে ক্রমেই তিনি গীতিকবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। গান রচনায় কাব্য, ছন্দ, অন্ত্যমিল, aশব্দচয়ন, উপমা, রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পে তিনি আলাদা অবস্থান করে নিয়েছেন সংগীত ভুবনে। আজ গুণী এই গীতিকবির জন্মদিন। তাঁকে জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে লিখেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত আরেক গীতিকবি কবির বকুল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। কিংবদন্তি গীতিকবি। ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, এই গীতিকবি প্রতিষ্ঠানের জন্ম ঝিনাইদহ জেলায়। আজ ’৮১–এর এই বাটে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আসি আসি করে ৮১ পেরিয়ে যাব কি? সমগ্র কোনো অস্তিত্বকে পাব কি?’
কিন্তু আমরা দেখি এখনো তাঁর কলমে ফুটে ওঠে টগবগে ভালোবাসাময় তারুণ্য। ‘ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়, তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছা হয়’ আরেক কিংবদন্তি আলাউদ্দিন আলীর সুরে অসম্ভব শ্রোতৃপ্রিয় এই গানটি কুমার শানু ও মিতালী মুখার্জির কণ্ঠে শোনার মধ্য দিয়ে আমরা অনুভব করি তাঁর গানের বাণী কতটা শক্তিশালী।

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় বাংলাদেশ বেতারের জন্য তিনি দুটি গান লিখেছিলেন। ‘দুঃখ আমার বাসররাতের পালঙ্ক, নিন্দা আমার প্রেম উপহার, সাতনরি হার কলঙ্ক।’ অন্যটি ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম, তবু একটা কিছু পেয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য হলাম।’ দুটি গানই সুর করেছেন প্রয়াত আরেক কিংবদন্তি সুরকার সত্য সাহা। আর গেয়েছিলেন প্রথমটি সাবিনা ইয়াসমীন। অন্যটি গেয়েছেন সুবীর নন্দী। এই দুটি গান রেডিওতে বেজে শ্রোতার কাছে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে গান দুটি পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।
যদিও ‘গান’ শব্দটি নিয়ে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের ঘোর আপত্তি। তিনি বলেন, ‘গান লেখা এই শব্দটি আমি অপছন্দ করি। কারণ, গান লেখা যায় না। গান মানুষ শোনে। আমি যেটা লিখি, সেটা যদি কারও সামনে দেওয়া হয়, তবে সেটা কেউ শুনতে পাবে না। তাহলে আমি কি লিখি। আমি যেটা লিখি, সেটা একটি কবিতা।

তিনি বলেন, ‘কেমন কবিতা, যে কবিতায় যে সমস্ত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, চয়ন করা হয়েছে, সে শব্দগুলো সুরের উপযোগী। পঙ্‌ক্তিগুলো সুরের উপযোগী। অর্থাৎ সুরের মুখ চেয়ে আছে মনে হবে। যেন, আহা এই পঙ্‌ক্তিগুলো যদি সুরে ফেলা যেত, তবে গান হয়ে উঠত।’

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের সঙ্গে কবির বকুল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান মনে করেন, গীতিকবিকে একজন কবি হতে হবে। সে যদি কবি না হয়, তার ভেতরে যদি একজন কবির বসবাস না থাকে, তাহলে সে যতই মিলিয়ে ঝুলিয়ে, যেভাবে যা–ই লিখুক না কেন, সেটা গান হয়ে উঠতে পারে না। গানকে অবশ্যই কবিতাশ্রয়ী হয়ে উঠতে হবে।
তাঁর লেখা আরও কিছু গানের কথা বলি, অনুপ ভট্টাচার্যের সুরে মিতালী মুখার্জির গাওয়া ‘শুকপাখিরে পিঞ্জিরা তোর খুলে দিলাম আজ, বুঝলাম আমি সুখ সে তো নয় খাঁচায় পোষার কাজ।’ কথার কাব্য এবং সুরের গভীরতা এ গানকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তেমনি আরেক কিংবদন্তি সুরকার খন্দকার নূরুল আলমের সুরে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে আমরা পেয়েছি আরেকটি কালজয়ী গান ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বল, ওই পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না/ তোমরা কেন বোঝো না যে কারও বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না’।
এ ছাড়া তাঁর লেখা আরও কিছু গানের কথা উল্লেখ করি। ‘পাবার সময় হতে না হতে যাবার সময় হয়ে গেল’ (কুমার শানু), মিতালী মুখার্জি ও তপন চৌধুরীর গাওয়া তিনটি গান ‘আকাশের সব তারা ঝরে যাবে’, ‘দিন কি রাতে সাঁঝ প্রভাতে’, ‘আজ ফিরে না গেলেই কি নয়’।

এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া দুটি গান, ‘আমার মতন এত সুখী নয় তো কারও জীবন,’ ‘পদ্মপাতার পানি নয়, দিনযাপনের গ্লানি নয়।’ এন্ড্রু কিশোর ও কনকচাঁপার কণ্ঠে দুটি গান, ‘কী জাদু করেছ বলো না, ঘরে আর থাকা যে হলো না’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’। আর শহুরে দর্শক–শ্রোতা যে গানের মাধ্যমে মমতাজকে চিনেছেন, সেই গানটি ‘রিটার্ন টিকিট হাতে লইয়া আইসাছি এই দুনিয়ায়, টাইম হইলে যাইতে হবে যাওয়া ছাড়া নাই উপায়’।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশের গানের কথা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পারে দাঁড়িয়ে/ এক মধ্যবয়সী নারী এখনো রয়েছে হাত বাড়িয়ে/ খোকা ফিরবে ঘরে ফিরবে কবে ফিরবে নাকি ফিরবে না’। কিংবা ‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে, কী দেখেছি, আমি বলব চোখের কাছে নাও না জেনে/ ওখানে বাংলাদেশের রূপ এঁকে রেখেছি’। রুনা লায়লার গাওয়া ‘আমার মন পাখিটা যায় রে উড়ে যায়/ ধানশালিকের গাঁয়/ যায় রে উড়ে যায়/ নাটা বনের চোরাকাঁটা ডেকেছে আমায়’। রফিকুল আলমের কণ্ঠে ‘আমার বাউল মনের একতারাটা/ হাজার নদী বাংলাদেশে, সুরের খেয়ায় ভেসে ভেসে, দুঃখ সুখের ঘাটে সে, দেখে কত জোয়ার–ভাটা’।  
আমার চোখে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তাঁর ‘দেহখেয়ায় দেবো পাড়ি’ বইটি তাঁকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে, সেই উচ্চতায় আর কেউ যেতে পারেননি।

এই বইয়ে তাঁর লেখা ১৯৫টি গীতিকবিতা স্থান পেয়েছে, সবগুলো গানই তিনি যে ‘ঘোর’–এর মধ্যে লিখেছেন, তা যদি সঠিক সুরে গান হয়ে ছড়িয়ে পড়ত, তাহলে এটা ‘জামান সংগীত’ হয়ে অনন্তকালের গান হয়ে বেঁচে থাকত। কারণ, প্রতিটি গীতিকবিতার চিন্তার ক্ষেত্র সুফি–প্রভাবিত মরমিয়া ভাবের এক অনন্য জীবনদর্শন।

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

লালন সাঁইজির গানের বাণীর সঙ্গেই এর তুলনা চলে। দুঃখের বিষয়, এই অসাধারণ সৃষ্টিগুলো এখনও ‘দেহখেয়ায় দেবোপাড়ি’বইবন্দী হয়ে আছে। একটি গানের কথা বলি, ‘একবার–আত্মতত্ত্ব আত্মসত্য জানা হলে/ অন্তর্লোকে প্রেমানন্দের দিব্যজ্যোতি উঠবে জ্বলে। ও সেই আপনারে চেন্ রে মনা–আঠেরো মোকামে ঘুরে দ্যাখ্ কোথা তোর আপনজনা/ ও তার আপন খেলা গোপন লীলা পথের দিশা দেবে বলে’।
বাংলা গীতি কবিতার প্রাণপুরুষ মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তিনি শিক্ষক। তিনি গীতিকবিতার প্রতিষ্ঠান। আমরা এ সময়ে যাঁরা আধুনিক বাংলা গান লিখি, তাঁদের মাথায় যে গৌরব মুকুট, আমি মনে করি সেই মুকুটটি তিনি। কারণ তাঁর কাছেই আমরা গান লেখার ব্যাকরণগত শিক্ষাটা পেয়েছি। এ বিষয়ে তাঁর লেখা ‘বাংলা গান রচনা কৌশল ও শুদ্ধতা’। বইটি আমাদের শুদ্ধভাবে গান লেখায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
৮১–এর এই অধ্যায়ে এসে তিনি বলেন, ‘সারা জীবন, জীবনের সম্পূর্ণতাকে খুঁজেছি, পাইনি। এখন অনন্তে মিশে যাবার পথ খুঁজি। পাব কি না, জানি না। তবে আমি আমার সকল অপূর্ণতার কাছেও ঋণী।’