২০১৫ সালে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে ওস্তাদ জাকির হোসেন
২০১৫ সালে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে ওস্তাদ জাকির হোসেন

প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার

চেয়েছি নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে: ওস্তাদ জাকির হোসেন

কিংবদন্তি তবলাবাদক ওস্তাদ জাকির হোসেন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। আজ সোমবার জাকির হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যার্থে নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ তবলা পরিবেশন করেছিলেন তাঁর বাবা ওস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতার ৪০ বছর উপলক্ষে প্রথম আলো ও ট্রান্সকম লিমিটেডের আয়োজনে ওস্তাদ আল্লা রাখা খাঁকে দেওয়া এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাজিয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত এই তবলাশিল্পী। ফায়ার ওয়ার্কসের ব্যবস্থাপনায় সে সংগীতায়োজনের পরদিন তিনি মুখোমুখি হন প্রথম আলোর। সাজ্জাদ শরিফ এর নেওয়া সেই সাক্ষাৎকার জাকির হোসেনের স্মরণে আবার প্রকাশ করা হলো।

প্রশ্ন

জীবনে তো আপনি কম প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। সম্ভবত সব প্রশ্নই আপনাকে করা হয়ে গেছে। এমন কোনো প্রশ্ন কি আছে, যার মুখোমুখি হওয়ার জন্য আপনি বহুদিন ধরে অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু কেউ আপনাকে প্রশ্নটা করেনি?

জাকির হোসেন: ও আল্লাহ্, পঁয়ত্রিশ বছর ধরে তো সাক্ষাৎকার কম দিইনি। প্রশ্নও আমাকে অজস্র করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও কোনো না কোনো নতুন প্রশ্ন তো থেকে যেতেই পারে। শুধু তো আমিই না, জীবিত যেসব সুরস্রষ্টা ও সংগীতশিল্পী আছেন, তাঁরাও অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। কখনো কখনো কাউকে কাউকে করা কোনো প্রশ্ন শুনে এমন মনে হয়েছে যে, আহা, ওই প্রশ্নটা কেউ যদি আমাকে করত। এ মুহূর্তে আমি অবশ্য ঠিক মনে করতে পারছি না ওই প্রশ্নগুলো কী ছিল। তবে গানের জায়গা থেকে করা হলে এমন একটা প্রশ্ন হয়তো আসতে পারে, এতগুলো বছর যে সংগীতের সঙ্গে আমি কাটিয়ে দিলাম, কী আমাকে এর সঙ্গে বেঁধে রেখেছে? ঠিক কোন কারণে সংগীত এখনো আমার কাছ থেকে তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেনি?

প্রশ্ন

ধরুন, প্রশ্নটা আমিই আপনাকে করেছি।

জাকির হোসেন: এই জিনিসটা বোঝার জন্য আমি বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু সত্যি সত্যি কখনো বুঝে উঠতে পারিনি। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি কীভাবে? যে জিনিসের সঙ্গে আপনি জীবনের মূল্যবান অনেকগুলো বছর পার করে দিয়েছেন, একসময়ে তার ভেতরের দিকটায় তাকাতেও আপনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে এর মধ্যে এমন কী আছে যা আপনাকে এভাবে আনন্দ দিচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে আপনাকে উত্তেজিত করে রাখছে, আপনাকে দিয়ে এত কিছু করিয়ে নিচ্ছে। এই প্রশ্নটা সব সময় আমাকে তাড়িয়ে ফিরেছে। তবে আমি আনন্দিত যে এর জবাব এখনো আমার জানা হয়নি। প্যান্ডোরার সেই বাক্স আমার খোলারও দরকার নেই। একটা জবাব খুঁজে বের করে কখনোই আমি বলতে চাই না যে, ও, এ-ই তা হলে উত্তর?

প্রশ্ন

নিজেকে কি এখনো আপনার খুব তুচ্ছ বা ভঙ্গুর মনে হয় সংগীতের সামনে?

জাকির হোসেন: হ্যাঁ, হ্যাঁ, সংগীত তো মারাত্মক চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। সংগীত এমন একটা পর্বতের মতো আপনার সামনে এসে হাজির হয় যার ওপরে আপনাকে আরোহণ করতে হবে। আপনাকে তখন এগিয়ে যেতে হয়; যতটা সাধ্য ওঠার চেষ্টা করতে হয়। কখনো আপনি আধাআধি ওঠেন, কখনো হয়তো পুরোটাই পেরে যান। যে ধরনের সংগীত আমরা করি, স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ হচ্ছে তার ভিত্তি—এই কথাটা মনে রাখা দরকার। কোনো কোনো দিন আমার মন হয়তো একটু বেশি স্পষ্ট, একটু বেশি নিবদ্ধ। পুরো পরিবেশনার মধ্যে সেদিন আমার মন খুব সাবলীলভাবে কাজ করে। পরিবেশনার আগে সাজঘরে বসে সে দিন মনে হয়, আমি যা কিছু আজ করতে চাই, তার সব উপাদান আমার সামনে হাজির। কোনো কোনো দিন কিছুই কাজ করে না। তখন মনে হয়, উফ্, আজকে আমার হবেটা কী? খুব ভঙ্গুর মনে হয় তখন নিজেকে। এই যে এবার ঢাকায় সংগীত পরিবেশন করলাম, এবারও এমনটা মনে হয়েছিল। এত বড় একটা হলঘরে এতগুলো অচেনা শ্রোতার সামনে, মঞ্চের ওপরে, আমি প্রাচীন একটি শাস্ত্রীয় সংগীত তুলে ধরতে যাচ্ছি। অথচ আমি জানি না, এই শ্রোতারা কেমন। আমি যা মেলে ধরতে যাচ্ছি, সেটাই তারা শুনতে চাইছেন কি না। আমার বুক দুরদুর করছিল। সাজঘরে আমার সহযোগী শিল্পী সাবির খানকে বললাম, আমি জানি না আজকে কী হবে? কিন্তু যখন দেখলাম, মঞ্চ প্রস্তুত, হলঘরে আমার চেনা বিভিন্ন ছবি টাঙানো, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি যখন দেখানো হলো, সঙ্গে সঙ্গে আমার মন নির্ভার হয়ে গেল। মঞ্চে উঠে আমার সব ভয়ডর চলে গেল।

পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দেওয়া খুবই দরকার ছিল। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে সেটা করাও গিয়েছিল। নানা জায়গা থেকে আসা সংগীতের সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে যে অসম্ভব ঘটনার কথা কল্পনা সম্ভব, সেই ঘটনাটা ঘটানো গিয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। পুরো ঘটনাটি আমি স্বচক্ষে দেখেছি। জর্জ হ্যারিসন শুধু কনসার্টের আয়োজন করেই থেমে যাননি, তিনি নিশ্চিত করেছিলেন প্রত্যেক শিল্পী যেন কিছু অর্থও অনুদান করেন। শিল্পীরা অনুদান-বাক্সে টাকা জমা দিচ্ছিলেন। আমি দেখেছি জর্জ হ্যারিসন নিজের হাতে বাক্সটি ধরে আছে, আর বব ডিলান চেক লিখে সে বাক্সে টাকা জমা দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে মানুষগুলোর জন্য কনসার্টটি করা হয়েছিল, তার প্রতি শিল্পীদের মমতা, প্রেম, উদ্দীপনা সবকিছু অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। সেটা ছিল বর্ণনার অতীত এক অভিজ্ঞতা।
ওস্তাদ জাকির হোসেন
ওস্তাদ জাকির হোসেন
প্রশ্ন

যে বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে আপনার কাজ-কারবার, সেই তবলার প্রসঙ্গে আসি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে এর ভূমিকা অসামান্য। কিন্তু কেউ নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবেনি, সেতার বা সরোদের মতো শুধু তবলা দিয়েই আসর মাত করা যাবে। আপনার বাবা ওস্তাদ আল্লা রাখা খাঁ ও আপনি—আপনারা মিলে তবলাকে একক পরিবেশনার যোগ্য করে তুলেছেন। একে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো?

জাকির হোসেন: অসম্ভব সম্ভব হয়েছে কি না, আমি বলতে পারব না। তবে সম্ভবত তবলার যুগের সূচনা ঘটেছে। তাই বলে এর সব কৃতিত্ব আমরা দাবি করতে পারব না। তবলায় আমরা বীর আলেকজান্ডার বা সম্রাট আকবর নই। সেটা দাবি করলে তবলার আরও বহু অসামান্য শিল্পীর অবদানকে খাটো করা হবে। ব্যাপারটা এমন নয় যে রাজা একা একা যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন, তারপর যুদ্ধজয় করে ফিরে এলেন। তার আরও বহু লোকের সমর্থন দরকার। মঞ্চে আমার বাবা আল্লা রাখাকে দেখার সৌন্দর্য ছিল অসামান্য। পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দীর মধ্যে এমন এক বৈদ্যুতিক ঝলক ছিল যে মানুষ তাঁর দিকে ফিরে তাকাতে শুরু করল। তারা বলতে শুরু করল, বাহ্, তবলা। লোকটা তো দারুণ! তাঁদের দুজনকে তারা পরিপূরক হিসেবে ভাবতে শুরু করল। তবলা এভাবে সবার নজর কাড়ল। তিনি একক পরিবেশনার জন্য নানা জায়গা থেকে ডাক পেতে শুরু করলেন। কিন্তু একক পরিবেশনা তখনো ছোট ছোট শ্রোতাগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তিনি বাজাতে এলে আরও কেউ কেউ আসতেন। আসতেন ওস্তাদ আহমেদজান থিরাকুয়া, ওস্তাদ আফাক হোসেন খাঁ, খলিফা ওয়াজেদ আলী, ওস্তাদ কেরামতউল্লাহ খাঁ, পণ্ডিত শামতা প্রসাদ, পণ্ডিত কিষাণ মহারাজের মতো সুমহান বাদকেরা। মানুষ হঠাৎ করে বিস্মিত হয়ে দেখতে শুরু করল, বাপ রে, এটা তো হেলাফেলা করার মতো কোনো বাদ্যযন্ত্র নয়। এর মধ্য থেকে বহু কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব। এই লোকগুলো আমার আসার পথ রচনা করেছেন। আমি তাঁদের পরের প্রজন্মের। আমি যখন এসেছি, তখন বাদ্যযন্ত্র হিসেবে তবলা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। আমার কাজের অর্ধেকটা তত দিনে সারা হয়ে গেছে। কয়েকটি ভাষায় বিচিত্র লোকের সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর যোগ্যতা আমার পরিবেশনায় কিছু মাত্রা যোগ করেছে। এতে পৃথিবীর সব জায়গাতেই তবলার সঙ্গে খুব সহজে শ্রোতাদের যোগাযোগ ঘটানো সম্ভব হয়েছে। খুব শক্তিশালী একটি মাধ্যমকে পরিচিত করানোর একটি মাধ্যম হিসেবে আমি কাজ করেছি। কিন্তু আবার বলছি, আমি কিন্তু অনেকের মধ্যে একজন। পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী, পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ—এঁরাও অসামান্য তবলাশিল্পী। এটা একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

আমি যদি অ্যালকোহল, গাঁজা বা এলএসডি-জাতীয় নেশার মধ্যে চলে যেতাম, তা হলে পৃথিবীর বিচিত্র সংগীতের মহান সুরস্রষ্টাদের উপাদানের অভিজ্ঞতা কি আমি গ্রহণ করতে পারতাম? এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার বা জ্ঞানের সেই ঝরনাধারার মধ্যে অবগাহন করার বাসনাই ছিল আমার প্রেম, আমার আবেগ, আমার প্রয়োজন। সে কারণেই হয়তো আমি আর অন্য কোনো পথের পথিক হতে পারিনি।
প্রশ্ন

আপনি তো ছিলেন বিস্ময়-বালক। বেশির ভাগ বিস্ময়-বালকই আসে ধূমকেতুর মতো, আর বড় হতে হতে ছাইয়ের মতো মিলিয়ে যায়। শাস্ত্রীয় সংগীতের দীর্ঘ যাত্রায় নিজের পথে আপনি একাগ্র রইলেন কী করে?

জাকির হোসেন: আসলে কি দেখুন, আপনি যেটা করছেন তার জন্য আপনার পাগলের মতো ভালোবাসা আছে কি না, সেটাই হচ্ছে আসল। আপনার কাছে সেটার আবেদন এতটাই তীব্র যে আর কোনো কিছুর দিকে তাকানোর অবকাশই আপনার নেই। কিছুদিন আগে প্রায় একশোটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের তরুণ প্রধানদের সঙ্গে আমি একটা প্রশ্নোত্তরপর্বে মিলিত হয়েছিলাম। তারা জানতে চাইল, কত রকমের সংগীতশিল্পীর সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন—তাদের মধ্যে রক অ্যান্ড রোল তারকারাও আছে—কিন্তু অ্যালকোহল বা ড্রাগের প্রতি আপনার কোনো আসক্তি জন্মাল না কেন? আমার উত্তর ছিল, যে সংগীত আমি পরিবেশন করি, এগুলো তো তার চেয়ে বেশি উত্তেজক নয়। এগুলো তো আমাকে সংগীতের চেয়ে বেশি গভীর মাত্রার উপলব্ধি, উত্তেজনা বা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেনি। তাই অন্যদিকে তাকানোর কোনো তাগিদই আমার ছিল না। আমি যদি অ্যালকোহল, গাঁজা বা এলএসডি-জাতীয় নেশার মধ্যে চলে যেতাম, তা হলে পৃথিবীর বিচিত্র সংগীতের মহান সুরস্রষ্টাদের উপাদানের অভিজ্ঞতা কি আমি গ্রহণ করতে পারতাম? এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার বা জ্ঞানের সেই ঝরনাধারার মধ্যে অবগাহন করার বাসনাই ছিল আমার প্রেম, আমার আবেগ, আমার প্রয়োজন। সে কারণেই হয়তো আমি আর অন্য কোনো পথের পথিক হতে পারিনি।

আমার বাবাকে কে যেন একবার বলেছিলেন, আপনার ছেলে যে আপনারই মতো হয়ে উঠছে, আপনার নিশ্চয়ই খুব গর্ব হয়? সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, আমি চাই, ও আমার চেয়েও বড় হোক। ওর মধ্যে এমন কিছু গুণ জন্মাক, যেগুলো ওকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে।
জাকির হোসেন
প্রশ্ন

কোনো এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, তরুণ বয়সে বাবার পথ আপনি অনুসরণ করতে চাননি।

জাকির হোসেন: সেটা আমি এখনো বলি, তবে অন্য অর্থে। আমার বাবাকে কে যেন একবার বলেছিলেন, আপনার ছেলে যে আপনারই মতো হয়ে উঠছে, আপনার নিশ্চয়ই খুব গর্ব হয়? সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, আমি চাই, ও আমার চেয়েও বড় হোক। ওর মধ্যে এমন কিছু গুণ জন্মাক, যেগুলো ওকে আমার থেকে আলাদা করে দেবে। আপনি যদি ভিসা করতে যান, ভিসা কর্মকর্তাও তো কপি করা কাগজ নেবেন না, তিনি আসল কাগজপত্রই চাইবেন। ফলে আমার বাবার কপি হতে চাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। আমার ভেতরে যেসব গুণ তিনি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন, তার সবটাই আমি নিতে চেয়েছিলাম। তার সঙ্গে আমার নিজেরও কিছু যুক্ত করতে চেয়েছি, যাতে আমার নিজের একটা পরিচয় দাঁড়ায়। আমার বাবা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন তাঁর ওস্তাদের থেকে একেবারে আলাদা। আপনি যদি আমার বাবা আর তাঁর ওস্তাদের বাজনা শোনেন, আপনি ধরতেই পারবেন না যে তাঁরা গুরু-শিষ্য। তাঁদের বাজনা এতই ভিন্ন রকমের। পণ্ডিত রবি শঙ্করের মধ্যেও একই জিনিস আপনি দেখতে পাবেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে তাঁর কোনো মিল নেই। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর ব্যাপারও একই। তাঁর বাজনাও তাঁর বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর চেয়ে আলাদা। ব্যাপারটা এই নয় যে আমি তবলা বাজাতে চাইনি। এই যন্ত্রটার সঙ্গে সব সময়ই আমার তীব্র আবেগময় একটা যোগ ছিল। কিন্তু আমি জানতাম, শ্রোতাদের কাছে যে জিনিসটা আমাকে উপহার দিতে হবে, তার নাম ঐতিহ্যবাহী সংগীত-সংবলিত জাকির হোসেন; ঐতিহ্যবাহী সংগীত-সংবলিত আল্লা রাখা খাঁ নয়।

প্রশ্ন

আমি লক্ষ করেছি, আপনার বাবার সঙ্গে যুগলবন্দী করার সময়ও আপনি তাঁর পরিবেশনায় মুগ্ধ হচ্ছেন এবং শ্রোতাদের সঙ্গে সেটা ভাগ করে নিচ্ছেন।

জাকির হোসেন: আমি তো তাঁর সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করিনি। আমি সব সময় তাঁর কাছ থেকে সংগীত শিখেছি। ধরুন, একজন ব্যাটসম্যান জীবনে প্রথম অজন্তা মেন্ডিস বা মুত্তিয়া মুরালিধরনের বলের মুখোমুখি হয়েছে, সে তো তখন শিখবে কী করে এসব প্রতিভার সঙ্গে ব্যাট করতে হয়। যে রকম বৈচিত্র্যময় বল তাঁরা দেবেন, তাঁদের বলের লাইন-লেংথ যে রকম হবে—সেগুলোর সঙ্গে তাকে খাপ খাওয়াতে হবে। যত বেশি ওঁদের সঙ্গে খেলবে, তত ভালো ব্যাটসম্যান সে হয়ে উঠবে। কারণ ওঁদের মতো প্রতিভাবানদের সঙ্গে খেলতে খেলতে নিজের দক্ষতার মধ্যে সে নতুন কিছু যুক্ত করতে পারবে। আমার ক্ষেত্রেও সেই ঘটনাই ঘটছিল। বাবার সঙ্গে বাজাতে বাজাতে প্রতিটা সময় আমি শিখছিলাম। যদি কখনো কোনো ঘরে আমি আমার বাবার সঙ্গে ঘটনাক্রমে একা হয়ে যেতাম, আমাকে শেখানোর জন্য তিনি খুবই উদ্গ্রীব হয়ে পড়তেন। কিন্তু তিনি যখন মঞ্চে বাজাতে বসতেন, তখন তাঁর মধ্যে এমন আরেকটা মাত্রা জেগে উঠত অন্য সময়ে তাঁর মধ্যে যেটা কখনো দেখা যেত না। তাই তাঁর সঙ্গে মঞ্চে থাকাটা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মঞ্চে তাঁর সঙ্গে বাজানোটা ছিল আমার জন্য একটা অনুশীলন-প্রক্রিয়া, একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মৃত্যুর মাসখানেক আগেও একটা অনুষ্ঠানে আমি তাঁর পাশে ছিলাম।

জাকির হোসেন
প্রশ্ন

আপনার বাবার অনুপস্থিতি কি অনুভব করেন?

জাকির হোসেন: যখনই আমি তবলার সামনে বসি, যতবার আমি তবলায় আঙুল স্পর্শ করি, ততবার আমি তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করি।

প্রশ্ন

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের গায়ক-বাদকদের মধ্যে সম্ভবত আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর জনপ্রিয়তা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে জাদুটা কী ছিল?

জাকির হোসেন: আগেই যে কথা বলেছি, আমাদের সময়ে এসে মঞ্চটা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। তথ্যমাধ্যম ও শ্রোতাগোষ্ঠী খেয়াল করল, আরে, ভারতীয় সংগীতের এমন অপূর্ব একটা অংশের দিকে তো আমরা কখনো তাকিয়ে দেখিনি। দেখি তো, এর মধ্যে কী আছে? তারা লক্ষ করছিল, ওস্তাদ থিরাকুয়া বা ওস্তাদ আল্লা রাখার পথ ধরে আর কে উঠে আসছে। আর ঠিক সেই সময়টায় আমি উঠে আসছিলাম। আমি ছিলাম মধ্যবর্তী প্রজন্মের সদস্য। ফলে হয়েছে কী, চার-চারটি প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে বাজানোর বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অতি অল্প বয়সে আমি সংগীতের আবহের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম। প্রবীণ শিল্পীরা কী করছেন, সেটা যেমন আমি দেখেছি; শাস্ত্রীয় সংগীত কোন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে, সেটাও আমার দেখা হয়েছে। আমি নিজেও সেই বিবর্তনের অংশ ছিলাম। এই গেল একটি দিক। ঠিক জায়গায় থাকাটাই সব সময় ঘটনা নয়। ঘটনা হচ্ছে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে থাকা। ঘটনাচক্রে আমি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাটায় উপস্থিত ছিলাম। বিচিত্র রকমের সংগীত ধারার মন্থনের সময়টাতে আমি সঠিক জায়গাটাতে হাজির ছিলাম। জন ম্যাকললিন যখন একজন তবলা-শিল্পী খুঁজছেন, আমি তখন সেখানে; কার্লোস স্যান্টানার যখন একজন ভারতীয় তবলা-শিল্পী প্রয়োজন, আমি সেখানে আছি। আমার বিরাট প্রতিভা ছিল, বা আমি দারুণ জনপ্রিয় ছিলাম—ব্যাপারটা মোটেই সে রকম না। সংগীতের বড় বড় মহাজন আমার মধ্যে হয়তো কিছু দেখতে পেয়েছিলেন, যে কারণে ভেবেছিলেন, আচ্ছা, এই তরুণটিকে নিয়ে দেখা যাক তো। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ যখন আমাকে বাজাতে দেওয়ার জন্য মঞ্চে তুললেন, আমার বয়স তখন বারো। তিনি কিছু দেখেছিলেন আমার মধ্যে। একবার কল্পনা করে দেখুন, সেই বিস্ময়কর প্রজন্মের প্রতিভাবানদের সঙ্গে আমি বাজাচ্ছি। আমি নিজেকে তুলে ধরার মতো মঞ্চ পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ছিলাম; আর একেবারে ঠিক ঠিক সংগীতগুরুরা চারপাশের অনেকের মধ্য থেকে আমাকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে যা কিছু শিখিয়েছিলেন, তার মাধ্যমে আমি সংগীতের এমন একটা ধরন তৈরি করলাম, যার মধ্যে শাস্ত্রীয় ও জনপ্রিয় দুই রকমের উপাদানই ছিল। আমি যে চায়ের বিজ্ঞাপন করেছি, সেটা আমাকে সাহায্য করেছে। আমি যে চলচ্চিত্রে গিয়েছি, তাও আমাকে সাহায্য করেছে।

প্রথম আলো ও ট্রান্সকম গ্রুপের আয়োজনে ‘ওস্তাদ জাকির হোসেন সন্ধ্যা’য় জাকির হোসেনের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন লতিফুর রহমান। পাশে মতিউর রহমান। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১। ফাইল ছবি
প্রশ্ন

আপনি তো ভারতের সবচেয়ে যৌন আবেদনময় পুরুষ হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। অন্য কোনো শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী সম্ভবত আপনার মতো এত নারী ভক্ত পায়নি।

জাকির হোসেন: কী বলছেন আপনি? তখন আমি যুবক। দেখতে সুন্দর ছিলাম। আমি শুধু ভাবতেই পারি যে, ওই অবস্থাটা যদি এখনো থাকত, যদি ওই রকম যুবক থেকে যাওয়া যেত। আমি যে কথা একটু আগে বলেছি, আমি শুরু করেছি অনেক আগে আগে। অত্যন্ত অল্প বয়স থেকে অনেক মহান সংগীতস্রষ্টার সঙ্গে আমি কাজ করতে শুরু করেছি। ফলে চল্লিশ বছর ধরে সংগীতের নানা রদবদলের মধ্যে আমি বেড়ে উঠেছি। এগুলোই হচ্ছে গিয়ে কারণ।

প্রশ্ন

যা হোক, আপনি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই ধরনের সুরস্রষ্টাদের সঙ্গেই কাজ করেছেন। আপনি কি এমন দু-চারজনের নাম করতে পারবেন যাঁদের সঙ্গে বাজিয়ে অসম্ভব আনন্দ পেয়েছেন?

জাকির হোসেন: দুই-তিনটা নামই বরং আমার পক্ষে করা সম্ভব। যেমন ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ। শিল্পী হিসেবে আমার গড়ে ওঠার পর্বে তিনি আমাকে অসম্ভব সাহায্য করেছেন। তিনি যে শুধু আমাকে শিখিয়েছেন, তা নয়। তাঁর সঙ্গে যে তিনি আমাকে বাজাতে দিয়েছেন, তার মাধ্যমেও। অনেকটা আমার বাবার মতো। আলী আকবর খাঁর সঙ্গে বাজাতে বাজাতে আমি তাঁর গভীরতর মাত্রা উপলব্ধি করেছি এবং সেগুলো আত্মস্থ ও ব্যবহার করে আমার নিজের বাজানোর মান উন্নত করেছি। পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে আমি বাজাচ্ছি আমার ষোলো বছর বয়স থেকে। তাঁরই হাত ধরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত মঞ্চে পরিবেশনযোগ্য একটি শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছে। আগে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত রাজরাজড়া বা নবাবদের দরবারেই পরিবেশন করা হতো। মঞ্চে সাধারণ মানুষের উপভোগ্য করে কীভাবে এ সংগীত পরিবেশন করা হবে তার কোনো সম্মত রীতি ছিল না। তখন ওস্তাদেরা আসরে বসে গাইতেন বা বাজাতেন। কেবল সংগীতবোদ্ধারা সে সংগীতের রস গ্রহণ করতেন। রবি শঙ্কর এই সংগীত সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উপায় খুঁজে বের করলেন। তিনি কথা আদান-প্রদান করতে শুরু করলেন শ্রোতাদের সঙ্গে। এগুলো বেশ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে শিখেছি সংগীতকে কীভাবে একটি আনন্দময় মঞ্চশিল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। শাস্ত্রীয় সংগীতের যে জ্ঞান আমার কাছে আছে, সেটা তো অতীতের। আমি মানুষের কাছে সেটা সহজ করে কীভাবে পৌঁছে দেব? রবি শঙ্কর যেটা সেতার দিয়ে করে দেখিয়েছেন, কাউকে না কাউকে তো সেটি তবলায় করে দেখাতে হবে। তো আমার কাঁধে সেই দায় পড়েছে। আলী আকবর খাঁ, রবি শঙ্কর, জন ম্যাকললিন, মিকি হার্ট—এঁরা আমাকে শিখিয়েছেন। মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে বা বক্তৃতা দিয়ে নয়; আমাকে তাঁদের পাশে থাকার সুযোগ দিয়ে, তাঁদের শিষ্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে। আজকে আমি যা হয়েছি, তাঁরাই আমাকে সেভাবে গড়ে তুলেছেন।

প্রশ্ন

সবাই বলেন, রবি শঙ্কর বা আপনি পাশ্চাত্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীতের মধ্যে একটা মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। আমার জানার খুব আগ্রহ যে এটা কীভাবে সম্ভব? দুই সংগীতের মূল ধাঁচটা তো আলাদা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত স্বতঃস্ফূর্ত, ইম্প্রোভাইজ্ড্। পরিবেশনের আগে এর রূপ নির্ধারিত নেই। অথচ পাশ্চাত্য সংগীতে পরিবেশনার রূপটি আগে থেকেই ছক কাটা, প্রি-কম্পোজ্ড্। আপনি ম্যাকললিনের সঙ্গে জ্যাজ করেছেন। জ্যাজের চলন অবশ্য স্বতঃস্ফূর্ত। সেটা ব্যতিক্রম।

জাকির হোসেন: না, না, জ্যাজকে বাদ দেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৮০-র দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত জ্যাজ ছিল পশ্চিমা গানের অন্যতম প্রধান একটি ধরন। হিপহপ বার্যাপ তখনো বাজারে আসেনি। ফ্র্যাংক সিনাত্রা, পেগি লি, লেনা হর্ন—এঁরা ছিলেন জ্যাজের অসামান্য গুণী শিল্পী। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, বলিউড পৃথিবীর সব জায়গার সব ধরনের গানের উপাদানই আত্মস্থ করে। বিশ বছর আগেও রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়ে আমরা দেখতাম সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রীরা একই ঘরে বসে আছেন। ঘরের এক পাশে বসেছেন বেহালা, চেলো, পিয়ানো, ড্রাম বাজানোর শিল্পীরা। আরেক পাশে হয়তো বসেছেন ঢোল, সেতার, সারেঙ্গি ইত্যাদির শিল্পীরা। ছোট্ট বয়সে আমি নিজে মদনমোহন, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, শঙ্কর-জয়কিষাণ, নওশাদ, শচীন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণ—এঁদের সবার জন্য বাজাতে বাজাতে আমি বড় হয়েছি। অনেক সময় আধাবেলা স্কুল করে আমি স্টুডিওর দিকে রওনা দিয়ে দিতাম। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া বা শিবকুমার শর্মার মতো শিল্পীরা আমাকে তাঁদের গাড়িতে তুলে স্টুডিওতে নিয়ে যেতেন। এলপি রেকর্ডিংয়ের জন্য আমি তাঁদের সঙ্গে বাজাতাম। আমি বলতে চাইছি, আমি বড়ই হয়েছি ভারতের যত বিচিত্র ধাঁচের শিল্পী ছিলেন তাঁদের সঙ্গে বাজাতে বাজাতে। ধাক্কা খাওয়ার বা প্রতিহত বোধ করার মতো কোনো অভিজ্ঞতা তাই কখনোই আমার হয়নি। আমি শিখেছি তবলাকে কীভাবে খাপ খাওয়াতে হয়। ওগুলোই আমার অনুশীলন হিসেবে কাজ করেছে। দ্বিতীয়ত, আপনি যেমন বলেছেন, গানের ধরন হিসেবে জ্যাজ চলনও স্বতঃস্ফূর্ত। ফলে আমাকে ঘিরে জ্যাজের শিল্পীরাও নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। তাই এটা একমুখী কোনো যাত্রা ছিল না; ছিল দ্বিমুখী যাতায়াত। আমরা মাঝামাঝি এসে মিলিত হয়েছি। তৃতীয়ত, তবলা বাজাতে গিয়ে আমি কেবল পুরোনো ঐতিহ্যের মধ্যেই ডুবে থাকতে চাইনি। এমনভাবে আমি ডুবে যেতে চাইনি যাতে এর বাইরের আর সবকিছু আমার নজরের বাইরে চলে যায়। আমি নমনীয় থাকতে চেয়েছি যাতে প্রয়োজনে নিজেকে বাঁকাতে-চোরাতে পারি। নিজেকে আমি খুলে রেখেছিলাম। এমন কোনো দিগন্ত আমি রচনা করিনি যে এর বাইরে আমি আর যাব না।

প্রশ্ন

চলচ্চিত্রের সঙ্গে যে আপনার একটা মধুর সম্পর্ক আছে, সেটা আমরা জানি। আপনি নিজেও বললেন। আপনি ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা বা বেরনার্দো বের্তোলুচ্চির মতো পরিচালকের ছবির জন্য বাজিয়েছেন। অপর্ণা সেনের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার ছবির জন্য সংগীত পরিচালনা করেছেন। তবলার ধ্রুপদি লহরা বাজানোর সঙ্গে এই অভিজ্ঞতার পার্থক্যটা কোথায় ছিল?

জাকির হোসেন: বুঝতেই পারছেন, দুইটার ধরনই দুই রকমের। একটায় আছে স্বতঃস্ফূর্ততা, আর ছবির জন্য যে সংগীত সেটা আপনাকে আগেই তৈরি করা। দুটোর চ্যালেঞ্জ দুই রকমের। এই দুইয়ের মধ্যে যাতায়াতের সামর্থ্য তখন আপনাকে রপ্ত করতে হয়। চলচ্চিত্রে আপনাকে কাজ করতে হয় একটা ছোট্ট জায়গার মধ্যে, কতগুলো শর্তের ভেতর। শাস্ত্রীয় সংগীতে আপনাকে খাপ খাওয়াতে হয় বিশাল একটা খোলা জায়গার সঙ্গে। ছোট্ট জায়গা আর বিরাট জায়গা—দুই জায়গায় কাজ করা দুই রকমভাবে শক্ত। চলচ্চিত্রে চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে এমন কিছু করতে হয়, যাতে প্রযোজক-পরিচালকও খুশি হন, শ্রোতারাও ওই সময়টুকুর মধ্যে তাঁদের তৃপ্তির খোরাক পান। মঞ্চে আমি পাই নব্বই মিনিট। আজকালকার সংগীত পরিচালকদের আমি সাধুবাদ জানাই। আগেকার যুগের সংগীত পরিচালকদের চেয়ে তাঁদের এখন অনেক বেশি কিছু করতে হয়। আগে শুধু ভারতবর্ষের লোকগান আর শাস্ত্রীয় গান থেকে নিলেই হয়ে যেত। এখন এর বাইরেও সারা পৃথিবীর রন্ধনকলার দিকে তাদের চোখ রাখতে হয়।

প্রশ্ন

শাস্ত্রীয় সংগীতকারদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে অতৃপ্তি কাজ করেছিল। তিনি পণ্ডিত রবি শঙ্কর আর ওস্তাদ বিলায়েত খাঁকে নিয়ে শুরুর দিকে কাজ করেছিলেন। পরে নিজের ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব তিনি নিজের হাতেই তুলে নেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ছবির আবহ রচনার চেয়ে সংগীতের শুদ্ধতা রক্ষার দিকে ওস্তাদদের ঝোঁক থাকে বেশি।

জাকির হোসেন: আমার অবশ্য মনে হয়, নিজের ছবিতে তাঁর যে উপলব্ধির জগৎ, তিনি চেয়েছিলেন যে আবহ সংগীতেও তার প্রতিফলন থাকুক। তাঁর ছবির সংগীতেও তিনি নিজে হাজির থাকতে চেয়েছিলেন বলে আমার ধারণা। ছবির জন্য তিনি কী চাইছেন, সত্যজিৎ রায় অনেক সময় সেটা সংগীত পরিচালককে না বলে যন্ত্রীকে বলতেন। তাঁর ছবির জন্য যিনি সেতার বাজাতেন সেই সুনীল বসু আমার সঙ্গেও ছবিতে কাজ করেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, সত্যজিৎ তাঁকে সুর বাজিয়ে শোনাতেন। বলতেন, এখানে আমি গম্ভীর একটা কিছু চাই, এখানে আমি কোমল সুর চাই। কোথায় কোন ধরনের রাগের অংশ দরকার, কোথায় অন্য ধরনের কিছু দরকার—এ সব তিনি বলে দিতেন। কোনো একটা ছবির জগৎ তিনি এভাবেই উপলব্ধি করতেন। তাঁর ছবি সম্পর্কে এটা তাঁরই ভাবনা-পরিকল্পনা, বিশেষ করে ছবির আবহ সংগীতের ব্যাপারে। বলিউডেও আজকাল একটি ছবিতে গানে সুর দিচ্ছেন একজন, কিন্তু আবহ সংগীত করানো হচ্ছে হয়তো অন্য আরেকজনকে দিয়ে। বলতে পারেন, আমি একটু বেদনাই বোধ করি যে যন্ত্রীদের সঙ্গে যে যোগাযোগটা সত্যজিৎ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে সে রকম কোনো যোগাযোগ তাঁর গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সবকিছুর পরও এই কথাটাই বলতে হবে, ছবিতে সত্যজিৎ রায় যে সংগীত সৃষ্টি করেছেন, সেটা তাঁর নিজের অন্তর্দৃষ্টির অংশ।

প্রশ্ন

জিজ্ঞেস করার মতো আরও অনেক প্রশ্ন আমার হাতে রয়ে গেল, কিন্তু সময় যে শেষ। শেষ একটা প্রশ্নই করি। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হওয়ার ঠিক আগের বছর আপনি আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য নিউ ইয়র্ক চলে গেছেন। কনসার্টের সময় ঘটনাটা ঠিক কী ঘটছিল? কনসার্ট নিয়ে আপনার নিজের দু-একটা স্মৃতি বলবেন?

জাকির হোসেন: সেটা ছিল রীতিমতো একটা অসম্ভব কাণ্ড। কিন্তু সেটা করা খুব জরুরিও ছিল। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দেওয়া খুবই দরকার ছিল। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে সেটা করাও গিয়েছিল। নানা জায়গা থেকে আসা সংগীতের সম্মিলিত শক্তির মাধ্যমে যে অসম্ভব ঘটনার কথা কল্পনা সম্ভব, সেই ঘটনাটা ঘটানো গিয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। পুরো ঘটনাটি আমি স্বচক্ষে দেখেছি। জর্জ হ্যারিসন শুধু কনসার্টের আয়োজন করেই থেমে যাননি, তিনি নিশ্চিত করেছিলেন প্রত্যেক শিল্পী যেন কিছু অর্থও অনুদান করেন। শিল্পীরা অনুদান-বাক্সে টাকা জমা দিচ্ছিলেন। আমি দেখেছি জর্জ হ্যারিসন নিজের হাতে বাক্সটি ধরে আছে, আর বব ডিলান চেক লিখে সে বাক্সে টাকা জমা দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যে মানুষগুলোর জন্য কনসার্টটি করা হয়েছিল, তার প্রতি শিল্পীদের মমতা, প্রেম, উদ্দীপনা সবকিছু অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। সেটা ছিল বর্ণনার অতীত এক অভিজ্ঞতা।