শাফিন আহমেদের বাবা কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও মা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম
শাফিন আহমেদের বাবা কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও মা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম

শাফিন আহমেদের স্মৃতিতে বাবা কমল দাশগুপ্ত ও মা ফিরোজা বেগম

জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বৃহস্পতিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শাফিন আহমেদের বাবা কিংবদন্তি সুরকার কমল দাশগুপ্ত ও মা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। তাঁদের কনিষ্ঠ সন্তান শাফিন আহমেদ মা–বাবার জন্মদিনে স্মৃতিচারণা করেছেন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত শাফিন আহমেদের সেই লেখাটি আজ আবার প্রকাশ করা হলো।

আমাদের ছোটবেলা কেটেছে কলকাতায়। খুব অল্প সময় সবাই ছিলাম কলকাতার অ্যান্থনি বাগান লেন ও ঢালিগঞ্জে। কলকাতার কথা খুব মনে পড়ে। আব্বা তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত। মা-ও তখন বেশ পরিচিতি পেয়ে গেছেন। এত কিছুর মধ্যে আমাদের বড় করার জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে তাঁকে। একজন শিল্পী হিসেবে মা অনেকটা সময় সংগীতের বাইরে ছিলেন। আমাদের নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানো, জামা বানানো, শরীরচর্চা—সবকিছুতে মা খুবই যত্নশীল ছিলেন।
১৯৬৭ সালের দিকে মাসহ আমরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলাম। উঠি এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায়। বাবা এসেছিলেন আরও পরে। ঢাকায় আমাদের স্কুলে ভর্তি করালেন। দেখাশোনার পাশাপাশি মা ঢাকায় ফিরে গানেও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খুব অল্প সময়ে দেশ ও দেশের বাইরে ব্যস্ততা বাড়ে তাঁর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও মা ব্যস্ত হন। তখনকার রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ফিরোজা বেগম ছাড়া কিছুই কল্পনা করেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা তরুণ বয়সে পা দিয়েছি। তখন কিছু বুঝি। মায়ের সঙ্গে কলকাতায়ও গেছি। কলকাতায় মায়ের ব্যস্ততা দেখেছি। শুধু ব্যস্ততা নয়, ওখানে যে নজরুলের গান নিয়ে সফল হওয়া সম্ভব, তা দেখিয়েছেন তিনি। প্রতি মাসে তিন-চারটা একক কনসার্ট করতেন। এ জন্য বলা হয়, নজরুলের গান জনপ্রিয় করার জন্য ফিরোজা বেগম যুদ্ধ করেছেন।

ফিরোজা বেগম

মঞ্চে নিজেকে উপস্থাপনার ঢংটাও ছিল মায়ের অন্য রকম। তাঁর প্রিয় রং ছিল সাদা। গানের সময় মঞ্চে তাই সাদা শাড়ি পরতেন। তাঁর স্টাইলটাও ছিল অনুকরণীয়। মা প্রথমার্ধে নিজের পছন্দের আর দ্বিতীয়ার্ধে অনুরোধের গান করতেন। মিলনায়তনে বসে শুনতাম। মা সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন রবীন্দ্রসদন আর কলামন্দিরে। বড় পরিসরে হলে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে হতো ফিরোজা বেগমের একক কনসার্ট।
মায়ের সঙ্গে আমি মঞ্চ শেয়ারও করেছিলাম। আব্বার সুরে নজরুলের গান ‘গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙে যায়’ গেয়েছি। আমি আর মা একটা বড় কনসার্টেও গান করেছিলাম দুই ভাষাতে। মা উর্দু ভার্সন আর আমি বাংলায় সমান্তরালভাবে। এটা ব্যতিক্রমী ব্যাপার হয়েছিল।
মা একটা গানের স্কুল চালু করেছিলেন। ‘কলগীতি’ নামের এই স্কুল ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল মায়ের। এই স্কুলে পরিচিত অনেক শিল্পী গান শেখাতেন। আমিও মায়ের স্কুলে গিটার শেখাতাম।

ব্যস্ততার কারণেই নিজের শরীরের দিকে খেয়াল করতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেলেন। মা-ই আমাদের অভিভাবক। ঈদের সময় একটা বিষয় আমাদের বাসায় পালন করা হতো। মা সব সময় রান্না করে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। মায়ের হাতের বিশেষ কিছু পদের রান্না অবিশ্বাস্য রকম সুস্বাদু ছিল।

খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আব্বা-আম্মা দুজনই খুব শৌখিন ছিলেন। ফরিদপুর, কলকাতা, ঢাকা এত জায়গায় ঘোরাঘুরি করার পরও দেশি-বিদেশি খাবার বানানোতে মা এতটা দক্ষতা কীভাবে অর্জন করেছিলেন, তা আমি জানি না। আমার মনে হয়, শিল্পীরা রান্নার দিকে গেলে ভালো করেন। মায়ের হাতে যে কটা পদ স্পেশাল হতো, তার মধ্যে লেম চপ, স্ক্রাম্বলড এগ, শর্ষে ইলিশ, পাতা দিয়ে মোড়ানো, টমেটো আর ঝোল দিয়ে কই মাছ, মাগুর মাছ। বাবা তো এসব খাবার খুব মজা করে খেতেন। ঈদের সময় মায়ের হাতের পাতলা সেমাই সবাই বেশ মজা করে খেতাম।

আট হাজার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত

আমরা যখন গানের জগতে পরিচিতি পেতে শুরু করেছি, শুরুর দিকে তো মা–বাবা নিষেধ করেননি, কিন্তু উৎসাহ দিয়েছেন তা-ও নয়। গানের জগতে আমরা যেন না আসি, মা তেমনটাই চেয়েছিলেন। আমরা যখন নিজেদের বাংলা গান নিয়ে জনপ্রিয়, তখন মাকে গর্ব করতে দেখেছি। কোনো কোনো সময়ে গভীর আলোচনা করতেন। কোন ধরনের অনুষ্ঠান করা উচিত—এ নিয়েও মা কথা বলতেন। গান গাওয়ার ব্যাপারে অনেক ধরনের কৌশলও শিখিয়েছেন মা।

মায়ের যে এতটা সাফল্য, তাতে বাবাও ভীষণ আনন্দিত ছিলেন। প্রায়ই দেখতাম, আব্বা দরজায় দাঁড়িয়ে মায়ের গান শুনছেন। মায়ের একটা রুম ছিল, নাম আনন্দভুবন। মায়ের গানের যত সংগ্রহশালা ছিল, সবই ওখানে।

শাফিন আহমেদ

বাবাকে আমরা খুব ভয় পেতাম। শুধু একটা বিষয়ে বন্ধুত্ব ছিল। সেটা ক্রিকেট। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে খেলা চলছে, আমরা তিন ভাই (মোহাম্মদ তাহসীন, হামিন আহমেদ, আমি) ও বাবা একসঙ্গে ধারাবিবরণী শুনতাম। তখন তো টেলিভিশন ছিল না। রেডিওর সিগন্যাল পাওয়ার জন্য শীতের সকালে ছাদে গিয়ে রেডিওর অ্যানটেনা বড় করে সেটাতে তার দিয়ে বেঁধে ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার ধারাবিবরণী শুনতাম। ওই সময়টা বাবার সঙ্গে খুব দারুণ কাটত। তখন মনেই হতো না, এই বাবাকে আমরা এতটা ভয় পাই। তবে বাবা যখন পড়াতে বসতেন, তখন খুব বকাঝকা দিতেন।
অদ্ভুত একটা ব্যাপার হচ্ছে, মা–বাবা কখনোই বড় আকারে জন্মদিন পালন করতেন না। তবে আমরা বড় হওয়ার পর মায়ের জন্মদিন অনেক বেশি পালন করতাম। ২৮ জুলাই মা-বাবা দুজনের জন্মদিন। তাই দুজনকে নিয়ে একসঙ্গে স্মৃতিচারণা করছি।