‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য

স্বপ্ন যাবে বাড়ি: ফিরে ফিরে আসে যে গান

‘জীবিকার তাগিদে ঢাকায় থাকি, পাঁচ বছর পর এবার ঈদে বাড়ি ফিরছি। যাত্রাপথে গানটা বারবার শুনছি, মনের অজান্তেই চোখ ভিজে এসেছে।’ ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন রিদওয়ান মাহমুদ। বিজ্ঞাপনচিত্রের ‘থিম সং’ থেকে দেশের মানুষের ঘরে ফেরার ‘থিম সং’–এ পরিণত হয়েছে গানটি।
২০০৯ সালের দিকে গ্রামীণফোনের একটি বিজ্ঞাপনের জন্য এ গানের সুর বাঁধেন হাবিব ওয়াহিদ, সংগীতায়োজনও তাঁর। গ্রামীণফোনের তৎকালীন কর্মকর্তা আনিকা মেহজাবীনের কথায় গানটি কণ্ঠে তোলেন শিল্পী মিলন মাহমুদ। বিজ্ঞাপনচিত্রটি টেলিভিশনে প্রচারের পরপরই দর্শকমহলে সাড়া ফেলে। অল্প সময়ের ব্যবধানে গানটি দর্শকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে গেঁথে যায়।

কোনো বিজ্ঞাপনচিত্রের ‘থিম সং’ আলাদাভাবে গান হিসেবে পরিচিত পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের ১৪ বছর পর আজও গানটির আবেদন রয়েছে। গানটির কথা, সুরের মায়াজালে ঘরে ফেরার আকুলি–বিকুলি উঠে এসেছে। এবার ঈদের ছুটিতে ঘরমুখী মানুষের মধ্যে গানটি নিয়ে চর্চা চলছে, যাত্রাপথের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে অনেকেই লিখছেন, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’। কেউ কেউ গানটি শেয়ার করে গানটি ঘিরে নিজের অনুভূতির কথা লিখছেন।
দর্শক–শ্রোতাদের এই ভালোবাসা ছুঁয়ে যায় শিল্পী মিলন মাহমুদকে। আজ দুপুরে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনেক ভালো লাগার। একটা গান যুগ যুগ ধরে টিকে আছে, এটা অনেক আনন্দের বিষয়। গানের অংশ হিসেবে আমি শ্রোতাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
পরে ২০১৩ সালে প্রকাশিত মিলন মাহমুদের ‘গোপনে’ অ্যালবামে রাখা হয় আলোচিত গানটি।

মিলন মাহমুদ

গানটি এতটা জনপ্রিয়তা পেল কেন
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি এতটা ছড়িয়ে পড়ল কেন কিংবা শ্রোতারা গানটিকে বছরের পর বছর ধরে গানটিকে জারি রেখেছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইম রানা জানান, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো গান বারবার বাজানো হলে তা মানুষের শ্রবণে গেঁথে যায়। এর দুটো দিক রয়েছে। গানটি ভালো মানের না হলে শ্রোতাদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে আর গানটি হৃদয়গ্রাহী হলে তা অনেক বেশি আত্তীকরণের মধ্যে চলে আসে।

সাধারণত লোকসংগীতগুলো হাই পিচে গাওয়া হয়। গানটা লোকসংগীত নয়, তবে হাই পিচে করা। সাধারণ মানুষ হাই পিচ পছন্দ করে, গানের কম্পোজিশনটাও ভালো।
সাইম রানা

সাইম রানা জানান, সাধারণ মানুষ উঁচু স্বরে (হাই পিচ) গাওয়া গান পছন্দ করেন। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটিও উঁচু স্বরে গাওয়া, ফলে সাধারণ মানুষের কাছে গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর ভাষ্যে, ‘সাধারণত লোকসংগীতগুলো হাই পিচে গাওয়া হয়। গানটা লোকসংগীত নয়, তবে হাই পিচে করা। সাধারণ মানুষ হাই পিচ পছন্দ করে, গানের কম্পোজিশনটাও ভালো।’
বিজ্ঞাপনচিত্রে গানটি শোনার পাশাপাশি ভিডিও চিত্রেও দেখেছেন দর্শকেরা; গানের ভিজ্যুয়ালাইজেশনও গানটি ছড়িয়ে পড়তে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক সাইম রানা।

‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য

মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত মানুষ রুটিরুজির প্রশ্নে মানুষ নগরজীবনে বসবাস করে। তবে তার মনটা পড়ে থাকে গ্রামে। এই গানের ভিজ্যুয়ালাইজেশনে দেখা যায়, বাসে, ট্রেনে কিংবা নদীপথে মানুষ বাড়ি ফিরছে—এর সঙ্গে শ্রোতারা নিজের মিল খুঁজে পান।’
বিষয়টি নিয়ে গানের শিল্পী মিলন মাহমুদ বলেন, ‘গানটি সবার আবেগকে এক সুতায় বেঁধেছে। গানের কথাগুলোর মধ্যে শ্রোতারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। দেশ কিংবা বিদেশ থেকে মানুষ ঘুরেফিরে প্রিয়জনের কাছে ফেরেন, ফেরার এই আবেদনটা সর্বজনীন। গানের কথা ও সুরের আবেদন মিলিত হয়েছে; সেই কারণে শ্রোতারা এটিকে নিজের গান হিসেবে ধরে নিয়েছেন।’

গানের জন্মকথা
২০০৯ সালে মিলন মাহমুদকে ফোন করে হাবিব গানটির কথা বলেন। হাবিবের ধানমন্ডির বাসার হোম স্টুডিওতে গিয়ে লিরিকটা পান মিলন মাহমুদ, তারপর সুর করছিলেন হাবিব।
মিলন মাহমুদের ভাষ্যে, ‘সুরটা হওয়ার পর ও নিজে গাইছিল। আমি বললাম, তোমার কণ্ঠেই তো ভালো হচ্ছে। হাবিব বলল, “ভাই আপনি খালি ভয়েসটা দিয়ে দেখেন, কী ঘটে দেখেন।” পরে ভয়েস দিলাম, এরপর পুরোপুরি ফিলটা পাল্টে গেল।’

বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পরপরই গানটি দর্শকের মনোযোগ কেড়েছিল। শিল্পী মিলন বলছেন, ‘প্রচারের প্রথম তিন দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, গানটা খুব হিট করছে। সেই সময় এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম, দেখলাম বাচ্চারা দুষ্টুমি করছে। এর মধ্যে বিজ্ঞাপনটা শুরু হতেই দুষ্টুমি থামিয়ে ওরা গানের প্রতি মনোযোগ দিল। সেটা দেখেই ভেবেছিলাম, এটা হিট করবে।’
গানটি তখন তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; মিলন মাহমুদ কোনো লাইভ শোতে গেলেই দর্শকেরা ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ বলে চিৎকার করতেন। গানটি না গেয়ে স্টেজ ছাড়তে পারতেন না তিনি।

‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য

স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২
মিলন মাহমুদের কণ্ঠে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ প্রকাশের সাত বছর পর ২০১৬ সালে গ্রামীণফোনের ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ বিজ্ঞাপনের থিম সংয়ের সুর ও সংগীতায়োজন করেন হাবিব ওয়াহিদ। রাসেল মাহমুদের লেখা এই গানে কণ্ঠ দেন শিল্পী মিঠুন চক্র। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের পর গানটি তুমুল আলোচিত হয়, গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ নিয়ে খুব আলোচনা হলেও অনেকেই জানেন না গলাটা কার। অনেকে মনে করেন, হাবিব ওয়াহিদের কিংবা মিলন মাহমুদের। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানের গলা মিঠুন চক্রের সেটা জানে না।’
মিঠুন চক্র

তবে দর্শকের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ ও ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ একই গান। আজ সন্ধ্যায় মিঠুন চক্র মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানটি নিয়ে খুব আলোচনা হলেও অনেকেই জানেন না গলাটা কার। অনেকে মনে করেন, হাবিব ওয়াহিদের কিংবা মিলন মাহমুদের। ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গানের গলা মিঠুন চক্রের সেটা জানে না।’

আসলে দুই গানের শিরোনাম একই হলেও কথা পুরোটাই আলাদা, লিখেছেনও ভিন্ন দুই গীতিকার। তবে দুই গানের সুরের খানিকটা মিল থাকায় ধন্দে পড়তে হয়েছে দর্শকদের।
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি ২’ গান দিয়ে গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মিঠুন চক্র। গানটি তাঁকে পরিচিতি এনে দিলেও খানিকটা অভিমানও রয়েছে মিঠুনের। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞাপনের কোথায়ও গায়কদের বিবরণ দেওয়া থাকে না। আবার এমনও হতে পারে, মানুষ জানতে চায় না। আমি ফেমাস হই আর না হই, দুঃখ নেই। থিম সংটা মানুষ পছন্দ করেছে—এটিই ভালো লাগার।’

মিঠুন চক্র

মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কনসার্টে গানটি পরিবেশন করেছিলেন মিঠুন। কনসার্ট শেষে একজন তাঁকে বলেছিলেন, গানটি আপনার, জানতাম না। ২০২১ সালের দিকে নিজের কণ্ঠে গানের আনপ্লাগড সংস্করণ প্রকাশ করেন তিনি। গ্রামীণফোনের ক্যাম্পেইনের নাম ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’, ক্যাম্পেইনের নাম অনুসারেই গানের নামকরণ হয়েছে।
‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘মুড়ির টিন’, ‘টাকা পাখি’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত গানের রিদম অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন মিঠুন।