‘সে তারা ভরা রাতে/ আমি পারিনি বোঝাতে/ তোমাকে আমার মনের ব্যথা/ তুমি তো বলেছ শুধু/ তোমার সুখের কথা’ আইয়ুব বাচ্চুর বিখ্যাত গানগুলোর একটি। রাতের আঁধারে গানটা শুনে মন কেমন করে ওঠেনি, এমন সংগীতপ্রেমী মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে নিজেকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথটা মোটেই সহজ ছিল না তাঁর। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছেছেন তিনি। কেবল ব্যান্ড সংগীতপ্রেমী শ্রোতায় নয়, কমবেশি সব ঘরানার শ্রোতারই মন জয় করতে পেরেছিলেন তিনি। দুরূহ কাজটি কীভাবে সম্ভব হলো? কীভাবে আইয়ুব বাচ্চু হয়ে উঠেছেন সবার? আজ ১৬ আগস্ট প্রয়াত এই সংগীতশিল্পীর জন্মদিন। এ উপলক্ষে খোঁজা যাক শিল্পীর জনপ্রিয়তার কিছু কারণ।
দেশকে নিয়ে গান বেঁধে, কবিতা-গল্প লিখে কবি-লেখক, শিল্পীরা আনন্দ পান। ‘তোমার মাঝেই স্বপ্নের শুরু তোমার মাঝেই শেষ/ ভালো লাগার ভালোবাসার তুমি আমার বাংলাদেশ/ আমার বাংলাদেশ।’ ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের গানে এভাবেই দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। বাংলাদেশ তাঁর কাছে কখনো ‘কবিতার ছোট্ট উপমা’, কখনো ‘শীর্ষ অনুভূতির পরে শূন্যতার বোধ’ আবার কখনো ‘গুমরে থাকা ক্রোধ’ হিসেবে সুরে সুরে ধ্বনিত হয়েছে। দেশের অপমানের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শো করতে গিয়ে ঘটনার ধারাবাহিকতায় নিউইয়র্কের গিটার সেন্টারের ম্যানেজারকে বলেছিলেন, ‘যে গিটারের জন্য দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আইয়ুব বাচ্চু দ্বিতীয়বার বাজায় না।’ দেশের প্রতি এই প্রগাঢ় ভালোবাসার তাগিদেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘তুমি ভোর রাত্রির প্রার্থনা, তুমি চেনা নদীর ঢেউ/ তুমি সুখের সেই দিনগুলি শেষে হারিয়ে যাওয়া কে।’ তাঁর ‘বাংলাদেশ’ গান যেমন মুগ্ধ করে তেমনি দেশের প্রতি মমত্ববোধও জাগ্রত করে।
আইয়ুব বাচ্চু নিজেকে ‘ভাড়াখাটা গিটারের ভাড়াখাটা প্রেমিক’ দাবি করতেন। বলতেন, ‘গান নয়, গিটার আমাকে ঘরছাড়া করেছিল। গিটারের জন্যই সংগীতযুদ্ধে নেমেছিলাম। সত্তরের দশকে আমি ভাড়ায় গিটার বাজাতে যেতাম। গিটারটাও ভাড়া নিয়ে যেতাম। ওই সময় ডিসকো কোম্পানির একটি গিটার আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা দিনপ্রতি ভাড়ায় গিয়ে শো করতাম। ভাড়া হিসেবে ৩০ টাকা দেওয়ার পর আরও ৫০ থেকে ৬০ টাকা থেকে যেত। এটা দিয়েই দিন চালাতাম।’
গিটারের প্রতি যে প্রবল ভালোবাসা, সেই ভালোবাসার জোরেই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি। তা ছাড়া তাঁর গানে আছে, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে/ একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে/ সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো/ গোপন করে।’
জীবনের পরতে পরতে মিশে থাকা কষ্টের রং ধুয়ে ধুয়ে যখন অঙ্গার হয়ে ওঠে তখন এই গান, গানের কথা কেবল আর আইয়ুব বাচ্চুর বলে প্রতিত হয় না। শ্রোতার আপন কথামালা হয়ে ওঠে। তাই তো মন খারাপে, ভালো মনে সুরে–বেসুরে আমরা গেয়ে উঠি, ‘মনে রেখো তুমি/ কত রাত কত দিন/ শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন।’
‘ফিলিংস’ ব্যান্ডদলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালে সংগীতজীবন শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু। প্রথম কণ্ঠ দেন গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা ‘হারানো বিকেলের গল্প’ শিরোনামের একটি গানে। ‘সোলস’ ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রায় এক দশক। তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’। তবে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ময়না’র মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। এ অ্যালবামের ‘ও বন্ধু তোমায়’ গানটি বেশ সাড়া ফেলেছিল।
‘চলো বদলে যাই’ শিরোনামের গানটি দোলা দেয়নি, এমন সংগীতপ্রেমী মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। ‘সুখ’ অ্যালবামের এ গানের মতো ‘কষ্ট’ অ্যালবামের গানগুলোও বহুল শ্রুত ও জনপ্রিয়। ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘কষ্ট কাকে বলে’ গানগুলো মানুষের মুখে ঘুরে ফেরে।
সহজ কথায়, মায়াময় সুরে, গিটারের পারঙ্গমতা দিয়ে নিমেষেই শ্রোতার মন জিতে নিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। জীবনানুভূতির প্রায় প্রতিটি বিষয়—প্রেম, বিরহ, দুঃখ, যাপিত জীবন ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলো উঠে এসেছে তাঁর গানে। কখনো তিনি বাঁধনহীনতার কথা বলেছেন। আবার কখনো বলেছেন সব কষ্ট দুহাতে সরিয়ে বদলে যাওয়ার কথা। তাঁর গানে আছে, ‘ফেরারি এই মনটা আমার/ মানে না কোনো বাধা/ তোমাকে পাবারই আশায়/ ফিরে আসে বারেবার।’ গান মনের কথা বলে, জীবনের দুঃখ-কষ্টকে উপভোগ্য করে তোলে। হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুঃখ কারও চোখে পড়ে না। কেউ ততটুকুই জানতে পারে যতটুকু কেউ তার সামনে উপস্থাপন করে, তাকে জানতে দেয়। জীবনের সুখের ভাগীদার অনেক, সুখের সময় অনেকেই পাশে এসে দাঁড়ায়। দুঃখের দিনে কিংবা জীবনের অতীব প্রয়োজনের দিনে অনেক কাছের মানুষকেই কাছে পাওয়া যায় না। এমনকি জীবনে দুঃখ-কষ্টের কথা খুলে বলার মতো একজন মানুষও খুব কম মানুষের ভাগ্যে মেলে। তাই তো আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো/ অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো/ দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা/ বোঝে না কেউ তো চিনল না’—এ গান সবার হয়ে উঠেছে।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যক্তির সামনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হয়। জীবন এক নিষ্ঠুর নাট্যশালা। যেখানে দক্ষ অভিনেতার মতো আমাদের অভিনয় করে যেতে হয়। জীবনানুভূতির এই নিটোল সত্যও উঠে এসেছে আইয়ুব বাচ্চুর গানে। শিবলীর লেখা গানে তিনি কণ্ঠে তুলেছেন, ‘বুকের এক পাশে রেখেছি/ জলহীন মরুভূমি/ ইচ্ছে হলে যখন-তখন/ অশ্রুফোঁটা দাও তুমি/ তুমি চাইলে আমি দেব/ অথই সাগর পাড়’। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের দুঃখের উদগিরণ এই গান। সে কারণেই কি গানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি?
তাঁর কনসার্ট মাতানো গান ‘মেয়ে তুমি কি দুঃখ চেনো’, ‘আমি ১২ মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে’ ‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে’ আজও বাসাবাড়িতে আনন্দ অনুষ্ঠানে বাজতে শোনা যায়। এই গানগুলো নতুন, পুরোনো এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মেও একই রকম জনপ্রিয়।
চলচ্চিত্রের গানেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৯৭ সালে প্রথম সিনেমার জন্য গান করেন তিনি। কাজী হায়াতের ‘লুটতরাজ’ সিনেমার ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ সিনেমার জন্য গাওয়া তাঁর প্রথম গান। গানটিতে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন কনকচাঁপা। গানটি ওই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরে কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’ সিনেমার ‘আম্মাজান আম্মাজান তুমি বড়ই মেহেরবান’ গানটিতেও কণ্ঠ দেন তিনি। আজও গানটা একই রকম জনপ্রিয়।
নিজেকে গিটারিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর গিটারের মূর্ছনায়, পারঙ্গমতায় মুগ্ধ হয়েছেন অগণিত দর্শক। গিটারিস্ট থেকে হয়েছেন পছন্দের গায়ক। নিজেই লিখেছেন, সুর করেছেন প্রশংসিত অগণিত গান। তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে ব্যান্ড মিউজিক, ব্লুজ, হার্ড-রক ইত্যাদি বিষয়গুলো শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হতে শুরু করে।
বাংলা ব্যান্ডসংগীতের ইতিহাসের এই কিংবদন্তির জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্রগ্রাম জেলায়। গান আর গিটারেই জীবনের স্বরলিপি রচনা করেছিলেন তিনি। পৃথিবীর নির্মম সত্য ফিরে যাওয়া। সবাইকেই ফিরে যেতে হয়। আইয়ুব বাচ্চু নিজেই গানে গানে সে কথা বলেছেন। ‘এই রুপালি গিটার ফেলে/ একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে/ সেদিন অশ্রু তুমি রেখো/ গোপন করে।’ ১৮ অক্টোবর ২০১৮ সালে ৫৬ বছর বয়সে রুপালি গিটার ফেলে না–ফেরার দেশে পাড়ি দেন তিনি।