কার্তিকের শেষ দিন, শীত আসতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। তবে প্রকৃতিতে বইতে শুরু করেছে হিম হাওয়া। শীতের এ আগমনীর মধ্যেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা রোডের সেনাপ্রাঙ্গণ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চার ব্যান্ড দলছুট, আর্ক, মাইলস ও নগরবাউলকে নিয়ে ‘ঢাকা রেট্রো’ কনসার্ট। ব্লু ব্রিক কমিউনিকেশনের আয়োজনে এ কনসার্টে মিলনায়তন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মাটিকাটা চেকপোস্ট এলাকার পাশের সড়কে ছিল মানুষের স্রোত। জায়গায় জায়গায় তরুণদের জটলা। মিলনায়তনে ঢুকতে দীর্ঘ সারি।
গতকাল সন্ধ্যাটা যেন ছিল বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সোনালি সময়, নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় চার ব্যান্ড এদিন বিমোহিত করেছে দর্শকদের। ইদানীং কনসার্টে তরুণদের উপস্থিতি বেশি থাকলেও এদিন বয়োজ্যেষ্ঠ দর্শকদেরও চোখে পড়েছে। বেশির ভাগই এসেছিলেন পরিবারসহ। সবাই যেন ফিরে গিয়েছিলেন সেই নব্বইয়ের দশকে। আর্ক ব্যান্ডের হাসানের কথায়, ‘একটুকরা নাইনটিজ যেন ফিরে এল’।
কনসার্ট শুরু হয় ডিরকস্টার শুভর পারফরম্যান্স দিয়ে। তারপর দলছুট, অনি-জন-জামশেদ ত্রয়ী, আর্ক ও মাইলস সংগীত পরিবেশনা করে। কিন্তু সেনাপ্রাঙ্গণ মিলনায়তন যেন আরেকজনের অপেক্ষায় উদ্গ্রীব। মাইলস তাদের পারফরম্যান্স শেষ করার পর চারদিকে একটি আওয়াজ, গুরু-গুরু। তাদের পারফরম্যান্সের ঠিক ৩০ মিনিট পর রাত ১১টায় স্বভাবসুলভ ঢঙে মঞ্চে আসেন নগর বাউল জেমস। গিটার হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জনতা উল্লাসের উন্মত্ততায় ফেটে পড়েন। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের নক্ষত্র মাহফুজ আনাম, যাঁকে জেমস নামেই সবাই চেনেন।
কথা না বলেই গুরু ঢুকে গেলেন গানে, দরাজ কণ্ঠে স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় তিনি কণ্ঠে তুললেন ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না’। তাঁর সঙ্গে পুরো মিলনায়তনের দর্শকেরাও গলা মেলালেন।
এরপর তিনি একে একে গাইলেন ‘দিওয়ানা মাস্তানা’, ‘গুরু ঘর বানাইলা’, ‘মা’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘মীরা বাঈ’, ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’ ও ‘পাগলা হাওয়া’। এতটুকু ক্লান্তি নেই তাঁর! গানের বিরতিতে বারবার ভালোবাসা জানান ভক্তদের। গিটার দিয়েও নৈপুণ্য দেখিয়েছেন গুরু এবং তাঁর সুরের ঝংকারে বিমোহিত করেছেন সবাইকে। এভাবেই দিবাগত রাত ১২টায় মুগ্ধতা নিয়ে মিলনায়তন ছাড়েন শ্রোতারা।
এর আগে সন্ধ্যা ছয়টায় মঞ্চে আসে দলছুট। তারা একে একে পরিবেশন করে জনপ্রিয় গান ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘পরী’ ও ‘বাজি’। এরপর মঞ্চে আসেন অনি হাসান, জামশেদ ও জন কবির ত্রয়ী। প্রয়াত সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে তাঁরা পরিবেশন করেন, ‘হাসতে দেখ’ ও ‘ঘুমন্ত শহরে’। সবশেষ অনি হাসানের পূর্ণথার গিটার পারফরম্যান্স শেষ করেন তাঁরা।
এরপরই মঞ্চে আসে আর্ক ব্যান্ড। মঞ্চে এসেই হাসান জানান, দিনটা আজ স্পেশাল। নব্বইয়ের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল, একটুকরা নাইনটিজ যেন ফিরে এল।’ এরপরই তিনি পরিবেশনা করেন তাঁর ‘সুইটি’, ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’সহ আরও বেশ কয়েকটি গান।
ঘড়ির কাঁটা যখন পৌনে ১০টা, তখন মঞ্চে হাজির নব্বইয়ের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস। ‘এ মন কেন মানে না’ দিয়ে শুরু হয় তাদের পারফরম্যান্স। এরপর টানা এক ঘণ্টা একে একে তারা গান, পাহাড়ি মেয়ে, ফিরিয়ে দাওসহ জনপ্রিয় সব গান।
বিকেল ৪টা থেকে দিবাগত রাত ১২টা—টানা আট ঘণ্টা শ্রোতারা বুঁদ হয়েছিলেন গানে। একসঙ্গে গলা মিলিয়েছেন, নেচেছেন ও কেঁদেছেন। পুরো মিলনায়তন মুখর হয়েছে বারবার। জেমসের পারফরম্যান্স শেষে সমাপ্তি টানা হয় ‘ঢাকা রেট্রো’ আয়োজনের।
সাম্প্রতিক সময়ে কনসার্টে বিশৃঙ্খলার কিছু উদাহরণ তৈরি হলেও এই আয়োজন ছিল যথেষ্ট শৃঙ্খল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে নিরাপত্তারক্ষী, বাউন্সার ও পর্যাপ্ত ভলান্টিয়ার। আয়োজকেরা নিয়মিত বিরতিতে শ্রোতাদের বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক ও শৃঙ্খল থাকার কথাও বলেছেন।