প্রয়াত দুই শিল্পীর স্মরণে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত ‘মিতা-যুবরাজ উৎসব’–এর উদ্বোধন করেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার
প্রয়াত দুই শিল্পীর স্মরণে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত ‘মিতা-যুবরাজ উৎসব’–এর উদ্বোধন করেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার

‘দুটি মানুষের ভালোবাসা অটুট থাকুক’

‘যুবরাজ’ নামে পরিচিত মঞ্চ ও টিভি নাটকের অভিনেতা খালেদ খান ও তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হককে স্মরণ করলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা। প্রয়াত দুই শিল্পীর স্মরণে শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত ‘মিতা-যুবরাজ উৎসব’–এর উদ্বোধন করেন বরেণ্য অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। এ সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, নাট্যকার ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী। আলোচনা পর্বের আগে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন মিতা হকের গড়া সংগীত দল সুরতীর্থের শিল্পীরা।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘মিতা হক ও খালেদ খান দুজনই আমার পছন্দের মানুষ ছিল। বিশেষ করে যুবরাজের অভিনয়ের পাশাপাশি তার গাওয়া গান আমার ভালো লাগত। সব সময় তার ঠোঁটের কোণে একটা স্মিত হাসি লেগে থাকত। অন্যদিকে মিতার গানের কণ্ঠে মুগ্ধ হতাম। এপারে না থাকলেও ওপারে এই দুই মানুষের ভালোবাসা অটুট থাকুক।’

একাডেমির নিশাত চত্বরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বিকেল থেকে পরিবেশিত হয় বাউলগান। পরিবেশনা উপস্থাপন করেন আরিফ বাউল ও তাঁর দল। তাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ফকির লালন সাঁইসহ বাংলার শিকড়সন্ধানী লোকগান। এরপর পরিবেশনা পর্বটি চলে যায় নাট্যশালা মিলনায়তনে। এ পর্বের শুরুতে নাট্যশালার বারান্দায় ‘আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়’ গানের সুরে আহ্বান নৃত্য পরিবেশন করেন র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা ও তাঁর দল। এ ছাড়া মিলনায়তনে নৃত্য পরিবেশন করেন সামিনা হোসাইন এবং কস্তুরী মুর্খাজী ও তাঁর দল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

মঞ্চস্থ হয় মাসুম রেজা রচিত ও মোস্তাফিজ শাহীন নির্দেশিত নাটক ‘আবছায়ায় যুবরাজ’। প্রযোজনাটিতে অভিনয় করেন ইন্তেখাব দিনার, রওনক হাসান, ত্রপা মজুমদার ও জ্যোতি সিনহা। এ ছাড়া উৎসব উপলক্ষে খালেদ খান ও মিতা হকের বর্ণিল সাংস্কৃতিক জীবনের স্মৃতিময় নানা আলোকচিত্রের দেখা মেলে জাতীয় নাট্যশালার লবিতে।

অনুষ্ঠানে মফিদুল হক বলেন, অকালে ঝরে পড়া দুটি ফুল—খালেদ খান ও মিতা হক। শিউলী ফুলের মতো তাঁরা স্বল্প সময়ে ঝরে গেলেও রেখে গেছেন সৌরভ। এই শিল্পী দম্পতি শিল্পের সাধনায় নিজেদের জীবনকে উজাড় করে দিয়েছেন। সেই শিল্পের সাধনায় তাঁরা সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হৃদয়ের গহিনে ধারণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাঁদের মধ্যে মিতা হক রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। পরিবেশনার মাধ্যমে গানের বাণী বা বক্তব্যের দৃঢ়তাকে তিনি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শ্রোতার মননে। দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে তিনি সংগীতের আশ্রয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অভয় বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই উৎসবের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পী যুগলের প্রতিবাদী চেতনাটি ছড়িয়ে যাবে। তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই শিল্পী দম্পতির অভয়মন্ত্রকে ধারণ করবে।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, নিঃসন্দেহে একজন উঁচু মাপের অভিনেতা ছিলেন খালেদ খান। নাট্যমঞ্চের সেরা অভিনেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। আপন অভিনয়শৈলীর গুণে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য তিনি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।

অন্যদিকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে মিতা হক শুধু বাংলাদেশেই নন, ভারতের গণ্ডি ছাপিয়ে সব বাংলাভাষীর কাছে সমাদৃত হয়েছেন। পরিবেশনার মধ্যে তাঁর সাংস্কৃতিক বিশ্বাস ও দেশের প্রতি যে নিবেদন, তা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয়। এ দম্পতি নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তাই নতুনের আবাহনের এ পথ দেখাবে উৎসবে খালেদ খান–মিতা হক।

এ ছাড়া উৎসবে স্মৃতিচারণামূলক বক্তব্য দেন বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা।
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে মঞ্চের যুবরাজ ছিলেন খালেদ খান। আশির দশকে “নূরলদীনের সারা জীবন” ও “অচলায়তন” নাটকে তাঁর যে অভিনয়, তা আজও আমার হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। এই শক্তিমান অভিনেতা অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়নে আমৃত্যু কাজ করেছেন। একইভাবে মিতা হকও শিল্পী হিসেবে অসাম্প্রদায়িক দেশ ও রাষ্ট্র গড়ার কারিগর ছিলেন। এ ধরনের শিল্পীর মৃত্যু হয় না, দেহাবসান হয়।’

আয়োজনটি প্রসঙ্গে মিতা হকের মেয়ে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ফারহিন খান জয়িতা বলেন, ‘আমি মনে করি, একজন প্রকৃত শিল্পীর তাঁর দেশ ও সমাজের প্রতি আদর্শিক দায়বদ্ধতা থাকে। সৌভাগ্যক্রমে এই দম্পতির সন্তান হওয়ায় আমি দেখেছি তাঁদের সেই গুণটি। শিল্পচর্চার পাশাপাশি তাঁরা সমাজ নিয়ে ভেবেছেন, দেশ নিয়ে ভেবেছেন, সংস্কৃতি নিয়ে ভেবেছেন। পাশাপাশি তাঁরা নিজস্ব গণ্ডি এবং গণ্ডির বাইরে তাঁদের সেই দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতি যতবার আক্রান্ত হয়েছে, তাঁরা তাঁদের জায়গা থেকে কখনো নীরবে, কখনো সরবে কাজ করে গেছেন।’