লেখক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯১৯ সালে। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সওগাত’–এর জ্যেষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় প্রথম রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’। একই বছরে ‘মুক্তি’ শিরোনামে প্রথম কবিতাও প্রকাশিত হয়। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকসহ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারাতেই সোনার ফসল ফলিয়েছেন নজরুল। গান রচনায়ও তিনি স্থাপন করে গেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। গান রচনার ক্ষেত্রে কোনো ধরা-বাঁধা সময় বা নিয়ম ছিল না তাঁর। যেকোনো বিষয়ে যখন-তখন গান লিখে তাৎক্ষণিক সুরও করতে পারতেন নজরুল। কোনো গান তিনি লিখেছেন পাঁচ মিনিটে আবার কোনো গান শেষ করেছেন আধঘণ্টায়।
কখনো কখনো হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রথমে বিষয় ছাড়াই একটি রাগের সম্পূর্ণ কাঠামো তৈরি করে নিতেন নজরুল। তারপর প্রয়োজনীয় শব্দ সুরের সঙ্গে মিলিয়ে গান রচনা করতেন। আবার কখনো আগে গান লিখে তারপর সুর করতেন।
ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত ‘নজরুলগীতি অখণ্ড’র তৃতীয় সংস্করণ (জানুয়ারি ২০০৪) অনুযায়ী নজরুলের গানের সংখ্যা ২ হাজার ৫০৪। রশিদুন্ নবীর সম্পাদনায় নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘নজরুলসঙ্গীত সমগ্র’ (অক্টোবর ২০০৬) গ্রন্থমতে তাঁর গানের সংখ্যা ৩ হাজার ১৬৩। বিভিন্ন গ্রন্থে গানের সংখ্যার তারতম্য থাকলেও এটা অনুমেয় যে নজরুলের গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি।
‘নজরুল রচনা’র একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ। অক্ষরে অক্ষরে, শব্দে শব্দে নবসৃষ্টির উল্লাসে শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও কুসংস্কারের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। যাঁর রেশ এসে পৌঁছেছে গানেও। শুরুতেই ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানটির কথা বলা যাক। প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও দ্রোহে যুগে যুগে এ গান, গানের বাণী উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে প্রতিবাদের প্রতিরূপ হিসেবে গানটি পরিচিত হলেও নজরুল এটি লিখেছিলেন কবিতা হিসেবে। জানা যায়, মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে ব্রিটিশদের বিরোধিতা করায় সংগ্রামীরা একে একে কারারুদ্ধ হতে শুরু করেছেন। স্বদেশি ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ‘বাঙ্গালার কথা’ পত্রিকার সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাশও কারারুদ্ধ হন। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর। তাঁকে জেলে নেওয়া হলে পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হয় স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে। তরুণ কবি নজরুলের কাছে সুকুমাররঞ্জন দাশকে পাঠান বাসন্তী দেবী। উদ্দেশ্য ‘বাঙ্গালার কথা’র জন্য একটি কবিতা নেওয়া। এ প্রসঙ্গে ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, সুকুমাররঞ্জন কবিতা চাওয়ার পরপর নজরুল লিখতে শুরু করেন। ‘সুকুমাররঞ্জন আর আমি খুব আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর কবিতাটি লেখা শেষ করে নজরুল তা আমাদের পড়ে শোনাল। সুকুমাররঞ্জন খুবই খুশি হলেন।
‘এই কবিতাটি ছিল নজরুলের “ভাঙার গান”। নজরুলের নিয়ম ছিল, যেকোনো কবিতা ছাপতে দেওয়ার আগে সে নিজ হাতে কবিতাটির পরিষ্কার কপি তৈয়ার করে দিত। “ভাঙার গান”–এর ব্যাপারেও সে তা–ই করেছিল।’
‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বরের পরে এবং ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারির আগে কোনো এক দিন ‘ভাঙার গান’ রচিত হয়েছিল। কবিতাটি ‘বাঙ্গালার কথা’য় ছাপা হয় ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি। ১৯২৪ সালে ‘ভাঙার গান’ একই শিরোনামের (ভাঙার গান) বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার ‘ভাঙার গান’ নিষিদ্ধ করেছিল।
কবিতা কীভাবে গান হয়ে উঠল? শোনা যায়, কবিতাটি প্রকাশের পর চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলি জেলসহ বিভিন্ন জেলে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। এ ছাড়া ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ রেকর্ড করা হয়। গানটি গেয়েছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানটি বের হয়। ওই বছরই ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথমবার গানটি ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামেও ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেছিলেন সিনেমাটির পরিচালক জহির রায়হান। চলচ্চিত্রে জেলখানায় কারাবন্দীদের কণ্ঠে ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বারুদের মতো জ্বলে উঠেছিল। আজও দ্রোহে, সংগ্রামে আলতাফ মাহমুদের সুরে, খান আতাউর রহমানের সংগীতায়োজনে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।
কেবল ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ই নয়, গানে গানে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে নতুনকে আহ্বান জানিয়েছেন নজরুল। বলেছেন, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর! / তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’ যেখানে নতুনকে গ্রহণে পুরাতনের সব দ্বিধা লীন হয়ে গেছে। সমাজজীবনের পরতে পরতে মিশে থাকা অন্যায্য বন্ধন ভাঙার গানও গেয়েছেন নজরুল। বলেছেন, ‘এই শিকল–পরা ছল্ মোদের এই শিকল–পরা ছল/ এই শিকল প’রেই শিকল তোদের করব রে বিকল।।/ তোদের বন্ধ–কারায় আসা মোদের–বন্দী হ’তে নয়,/ ওরে ক্ষয় ক’রতে আসা মোদের সবার বাঁধন–ভয়’। তাঁর এ বাণী সব বাঁধন ভাঙার আহ্বানে উচ্চারিত হয়।
শোষণ, বঞ্চনা, পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের সংগ্রামমূলক গানের একটি অংশ জুড়ে আছে তরুণেরা। জীবন তুচ্ছ করে দেশের তরে, দশের তরে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের সংগ্রামী চেতনাকে সুরে সুরে, শব্দে শব্দে উদ্বুদ্ধ করেছেন নজরুল। ‘চল্ চল্ চল্! / ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল / নিম্নে উতলা ধরণী–তল, / অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল্ রে চল্ রে চল্/ চল্ চল্ চল্।।’ নজরুলের এ রণসংগীত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে। ‘আমরা শক্তি আমরা বল/ আমরা ছাত্রদল। / মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান/ ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল। / আমরা ছাত্রদল।।’ আন্দোলনে, সংগ্রামে নজরুলের এ বাণী সত্যি হয়ে ওঠে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মতো চঞ্চল। / মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছল।।’
গানের এ বাণী তরুণদের হৃদয়ে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, পরাধীনতার বিরুদ্ধে আস্ফালন বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা মানুষকে ভীত করে তোলে। নিজের অধিকারের কথা, স্বাধীনতার কথা জোরগলায় বলার সাহস কেউ কেউ সহজে করে উঠতে পারেন না। এই ‘বন্দিশালা’ থেকে মুক্তির আহ্বান জানিয়ে নজরুল লিখেছেন ‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত’। সাম্যের গান গাওয়া নজরুল ‘নারী’ কবিতায় যেমন বলেছেন, ‘বিশ্বে যা–কিছু মহান্ সৃষ্টি চির–কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তেমনই গানে নিজের অধিকার, পরাধীনতার বিরুদ্ধে কণ্ঠ তোলার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা। / জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।।’