নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় ফিডব্যাক, মাইলস, ফিলিংস, এলআরবির কনসার্টে শ্রোতাদের ঢল নামত। পরে তাতে ভাটা পড়ে। বছর পাঁচেক ধরে কলকাতার মঞ্চে ঢাকার ব্যান্ডগুলোর অংশগ্রহণ আবার বাড়ছে।
‘কলকাতায় ঢাকার ব্যান্ডগুলোর প্রচুর অনুসারী রয়েছেন। ঠিকঠাক প্রচার করা গেলে এখনো ওপারের (ঢাকার) ব্যান্ডের কনসার্টে প্রচুর দর্শক আসেন,’ গতকাল সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বললেন ‘মৈত্রী কনসার্ট’–এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান জেন নেক্সটের প্রতিষ্ঠাতা বিপাশ সরকার। ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ঢাকা ও কলকাতার রক ব্যান্ড নিয়ে ‘মৈত্রী কনসার্ট’–এর আয়োজন করছেন তিনি।
বিপাশ সরকার বললেন, ‘২০১৭ সালের দিকে আইয়ু্ব বাচ্চু স্যার আমাকে বলেছিলেন, “দুই দেশের ব্যান্ড নিয়ে কনসার্ট করতে পারিস।” তখন থেকেই “মৈত্রী কনসার্ট” নিয়ে কাজ শুরু করি, সেটি আলোর মুখ দেখার আগেই তিনি চলে গেলেন।’
আগামী ২২ ও ২৩ জুলাই কলকাতার রবীন্দ্রভবনে বসছে এ কনসার্টের পঞ্চম আসর। ঢাকার দুই ব্যান্ড মেঘদল ও আফটারম্যাথের সঙ্গে এতে কলকাতার কয়েকটি ব্যান্ডও গাইবে। আগের আসরে আর্টসেল, অ্যাভয়েড রাফা, পাওয়ার সার্জ, মেকানিক্সের পরিবেশনা উপভোগ করেন কলকাতার দর্শকেরা।
কলকাতায় ঢাকার ব্যান্ডগুলোর প্রচুর অনুসারী রয়েছেন। ঠিকঠাক প্রচার করা গেলে এখনো ওপারের (ঢাকার) ব্যান্ডের কনসার্টে প্রচুর দর্শক আসেন‘মৈত্রী কনসার্ট’–এর আয়োজক বিপাশ সরকার
দেড় যুগের বেশি সময় ধরে কনসার্ট আয়োজনে যুক্ত আছেন বিপাশ সরকার। বাংলাদেশের অনেক ব্যান্ডের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। তিনি জানান, ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কলকাতায় ঢাকার ব্যান্ডের বহু কনসার্ট দেখেছেন তিনি।
২০০৫ সালে দুই বাংলার শীর্ষ ব্যান্ড আর্বোভাইরাস, আর্টসেল, ওয়ারফেইজ, লক্ষ্মীছাড়া, ক্যাকটাসকে নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট রক কনসার্টের আয়োজন করা হয়। তবে কনসার্টটি দুই বছর পর বন্ধ হয়ে যায়।
শূন্য দশকের শেষ থেকে কলকাতায় ঢাকাই ব্যান্ডের আসা–যাওয়া কমতে থাকে। কারণ হিসেবে বিপাশ সরকার জানালেন, ট্যাক্স–সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ঢাকার আয়োজকেরা কলকাতার ব্যান্ড নিয়ে তেমন একটা কনসার্টের আয়োজন করছিলেন না। ফলে কলকাতার আয়োজকেরাও ঢাকার ব্যান্ড আনা কমিয়ে দেন।
কলকাতায় ঢাকার ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে?
পাঁচ বছর ধরে আবারও কলকাতার মঞ্চে ঢাকার ব্যান্ডগুলো ফিরতে শুরু করে। ঢাকার ব্যান্ড নিয়ে কলকাতার শ্রোতাদের আগ্রহও বেড়েছে। শ্রোতাদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই কলকাতার আয়োজকেরা আবার ঢাকামুখী হচ্ছেন।
কলকাতায় ঢাকার ব্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কলকাতার কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠান জ্যামসটেডির প্রতিষ্ঠাতা নিশিত আরোরা গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে আগে শোনে, আবিষ্কার করে, এভাবে আগ্রহ তৈরি হয়। তারপর ওই শহরে পারফর্ম করলে দেখতে চায়। গানের কোনো বাউন্ডারি নেই।’
‘ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবে আগে শোনে, আবিষ্কার করে, এভাবে আগ্রহ তৈরি হয়। তারপর ওই শহরে পারফর্ম করলে দেখতে চায়। গানের কোনো বাউন্ডারি নেই।’নিশিত আরোরা
কলকাতার কনসার্টে এখন নিয়মিতভাবে ঢাকার ব্যান্ডের দেখা মেলে। গত ১৪ এপ্রিল গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে গান পরিবেশন করে এসেছে মাকসুদ ও ঢাকা। ১৯৯২ সালে ও ১৯৯৪ সালে ফিডব্যাক ব্যান্ডে থাকাকালে প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গান করেন মাকসুদ। ফিডব্যাক ছাড়ার পর ১৯৯৭ সালের দিকে মাকসুদ ও ঢাকা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো কলকাতায় যান মাকসুদ, দুই দশকের বেশি সময় পর এবার কলকাতায় গেলেন তিনি।
কনসার্টটি আয়োজন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘সংস্কৃতি কানেক্ট’। সংস্কৃতি কানেক্টের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সৌরভ বিশ্বাস গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯৪ সালে ফিডব্যাককে তাঁরাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ পুরোটাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে দেব, বিষয়টি মাকসুদ ভাইকে জানানোর পর তিনি আগ্রহী হন।’
আমাদের শো নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে খুব আগ্রহ রয়েছে। আমাদের গান শুধু শহর কিংবা দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে বাংলাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা অবশ্যই অনেক ভালো লাগার বিষয়।টিপু, ওয়ারফেজ
দুই দিনব্যাপী কনসার্টের শেষ দিন ১৫ এপ্রিল গান পরিবেশন করে ওয়ারফেইজ, ২০১১ সালে শেষ তাদের কলকাতার মঞ্চে দেখা গেছে। ব্যান্ডের দলনেতা শেখ মনিরুল আলম গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শো নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে খুব আগ্রহ রয়েছে। আমাদের গান শুধু শহর কিংবা দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে বাংলাভাষী মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা অবশ্যই অনেক ভালো লাগার বিষয়।’ মনিরুল আলম জানান, কলকাতার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাঁদের নেওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করছেন, তাঁরা এখনো নিশ্চিত করেননি।
সোনার বাংলা সার্কাস, অ্যাশেজসহ বেশ কয়েকটি ব্যান্ড সম্প্রতি কলকাতায় একাধিক কনসার্ট করেছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় পাঁচটি কনসার্টে গান করেছে সোনার বাংলা সার্কাস, এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও গোয়াতে দুটি শো করেছে তারা। আগামী জুনে কলকাতার আরেক ব্যান্ড লক্ষ্মীছাড়াকে নিয়ে কলকাতার প্রিন্স টেন ক্লাবে সোনার বাংলা সার্কাসের কনসার্ট রয়েছে।
কলকাতার একাধিক কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রোতাপ্রিয়তার নিরিখে এই সময়ে কলকাতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্টসেল, অর্থহীন ও ওয়ারফেইজ।
এখন কাদের কদর বেশি
কলকাতার একাধিক কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রোতাপ্রিয়তার নিরিখে এই সময়ে কলকাতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্টসেল, অর্থহীন ও ওয়ারফেইজ। এর মধ্যে অর্থহীন ছাড়া বাকি দুই ব্যান্ডকে কলকাতার মঞ্চে একাধিকবার দেখা গেছে। অর্থহীনকে কখনোই কলকাতায় পাওয়া যায়নি, ব্যান্ডটিকে পেতে চেষ্টা করছে কলকাতার একাধিক প্রতিষ্ঠান।
সোনার বাংলা সার্কাসেরও আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মেকানিক্স, আফটারম্যাথ, কার্নিভ্যাল, স্টোয়িক ব্লিসসহ বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের বেশ পরিচিতি রয়েছে। ব্যান্ডের বাইরে শ্রোতাদের কাছে আনুশেহ আনাদিল, অর্ণব, আরমীন মুসা, মিনার রহমানকে নিয়ে কলকাতার শ্রোতাদের মধ্যে আলাদা আগ্রহ রয়েছে।
ঢাকার গায়কেরা কলকাতায় পারিশ্রমিক কেমন নেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নাম না প্রকাশের শর্তে কলকাতার একটি কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে কোনো ব্যান্ড পাঁচ লাখ টাকা নিলে কলকাতাতেও একই পারিশ্রমিক নেন।
সামনে কী
কলকাতার কনসার্ট আয়োজক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কলকাতার কনসার্টে ঢাকার ব্যান্ডগুলোর অংশগ্রহণ বাড়লেও ঢাকার কনসার্টে কলকাতার অংশগ্রহণ খুব একটা নেই। ফলে বিষয়টি নিয়ে জটিলতার মুখে পড়ার শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন কেউ কেউ।
‘মৈত্রী কনসার্ট’-এর আয়োজক বিপাশ সরকার বলছেন, ‘ওপার বাংলায়ও কিছু একটা করতে হবে। না হলে বিষয়টি নিয়ে এখানে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এখান থেকে দু–তিনটি ব্যান্ড গেলেও বিষয়টি মানা যায়।’ বিপাশ বলছেন, ঢাকা রক ফেস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলকাতার একাধিক ব্যান্ড থাকতে পারে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এর বাইরে কলকাতার লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ডকে নিয়ে ঢাকায় কনসার্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করছে সোনার বাংলা সার্কাস।
ভারত ও বলিউডে ঢাকার ব্যান্ড
আশির দশকের শেষ দিকে ফিডব্যাকের ‘মৌসুমী’ গানটি মুক্তির পর বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে। কলকাতাসহ বাংলাভাষী অঞ্চলের শ্রোতাদের সঙ্গে ফিডব্যাকের পরিচিতি ঘটে। এরপর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ব্যান্ডটি ভারতে কনসার্টে গেলে শ্রোতার ঢল নামে। এরপর মাইলস, ফিলিংস, এলআরবি নিয়মিত গান করেছে ভারতে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন ব্যান্ডশিল্পী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন সপ্তাহে দু–তিনটার বেশি শো থাকত ভারতে।’ শুধু পরিবেশনায় নয়; ফিডব্যাক, মাইলস, ফিলিংস, এলআরবিকে কলকাতার বহু ব্যান্ডশিল্পী অনুপ্রেরণা হিসেবে মানেন। ফসিলসের রুপম ইসলাম, অনুপম রায়সহ কলকাতার অনেক শিল্পীই তা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
ঢাকার ব্যান্ড তারকা জেমস বলিউডের ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় ‘ভিগি ভিগি’ গেয়ে শ্রোতাদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিলেন। এরপর ‘ও লামহে’ সিনেমায় ‘চল চালে আপনে ঘর’, ‘লাইফ ইন আ... মেট্রো’ সিনেমায় ‘আলভিদা’ ও ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমায় ‘বেবাসি’ গেয়ে আলোচিত হয়েছেন জেমস, তবে এরপর আর তাঁকে বলিউডে পাওয়া যায়নি।