‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যেদিন যাবে’ গানের মুখ শুনেই আঁতকে উঠলেন মান্না দে! প্রযোজকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী করেছেন! আমার মরণযাত্রা করে দিয়েছেন! আপনাদের বউদি এ গান আমাকে গাইতে দেবে না।’
মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় পূজা উপলক্ষে মান্না দের জন্য গানটি করেছিলেন। মান্না দে সাফ জানিয়ে দিলেন, গানটা তিনি করছেন না। মৃণাল-পুলকের মন ভেঙে গেল। কিছুদিন পর চলচ্চিত্র পরিচালক মনোজ ঘোষ ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবির জন্য ‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে’ গানটি পছন্দ করলেন। কিন্তু সেখানেও মুশকিল। মান্না দের কথা ভেবে বানানো এ গান মান্না না গাইলে কে গাইবে?
মনোজ ঘোষ ও মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় রওনা দিলেন মুম্বাই। গানটি শোনালেন কিশোর কুমারকে। ভালো লাগল তাঁর। তবে মুখরায় ‘তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো’র জায়গায় কিশোর ‘বারান্দা’ শব্দটা পছন্দ করলেন না। বললেন, ওখানে ‘আঙিনা’ করে দিতে হবে। দুজন এবার পড়লেন আরেক বিপদে। মুম্বাই থেকে ফোনে পাওয়া গেল না পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর অনুমতি না নিয়ে তো আর গানের শব্দ বদলানো যায় না! আবার সেটা না বদলালে কিশোর কুমারও গাইবেন না।
দ্বিমুখী এ বিপদ মাথায় নিয়ে এল রেকর্ডিংয়ের দিন। রেকর্ড করতে এলেন কিশোর কুমার এবং গানের মধ্যে ডুবে গেলেন। শুরু করার আগে একবার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন, ‘বড় ভালো সুর করেছ, মৃণাল।’ তারপর ‘বারান্দা’ নিয়ে কোনো কথা না বলে গানটা গেয়ে ফেললেন।
এ গল্প অনেকেরই জানা। আজ এ গল্পের অবতারণা, কারণ আজ কিশোর কুমারের ৯৪তম জন্মদিন। মরণযাত্রায় পাড়ি জমানো কিশোর কুমার অমরত্ব নিয়ে আজও বসে আছেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের আসনে। যে কারও মরণযাত্রায় তাঁর গাওয়া এ গান না বাজলেও বুকের মধ্যে ঠিকই বেজে ওঠে—‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যেদিন যাবে’। সে কারণেই হয়তো তাঁর গাওয়া গানের পঙ্ক্তি ধার করে বলতে হয়—‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’, আজ কিশোরের জন্মদিন।
‘ওপারে থাকব আমি তুমি রইবে এপারে, শুধু আমার দুচোখ ভরে দেখব তোমারে’ আজও গীত হয় নানা প্রজন্মের শিল্পীদের কণ্ঠে। অনেকে হয়তো বিস্ময় নিয়ে শোনেন গানটি, জানা হয় না যে এটা কিশোরের গান কিংবা ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’ গানটি! এ রকম বহু গান আছে, যার বেশির ভাগই শ্রোতাকে আজও দোলা দিয়ে যায়। আছে হিন্দি গানও। সেই তালিকায় রয়েছে ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’, ‘হামে অর জিনে কি’, ‘দেখা এক খাওয়াব’, ‘সাগার কিনারে’, ‘চেহরা হে ইয়া’, ‘ইয়ে দোস্তি’, ‘রিমঝিম ঘিরে সাওয়ান’সহ একগুচ্ছ গান। কেবল বাংলা বা হিন্দি নয়, কিশোর গেয়েছেন মারাঠি, গুজরাটি, অসমিয়া, মালয়ালম, ওড়িয়া, ভোজপুরি ও কন্নড় ভাষায়।
আইনজীবী কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও গৌরী দেবীর ছোট ছেলে কিশোর কুমারের আসল নাম আভাস কুমার। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট। ব্রিটিশ ভারতের সেন্ট্রাল প্রভিন্স বা আজকের মধ্যপ্রদেশের খন্ডোয়া অঞ্চলে। সেখানকার এক ধনী পরিবারের আইনজীবী ছিলেন কিশোরের বাবা কুঞ্জলাল।
কিশোর যখন ছোট, তাঁর বড় ভাই অশোক কুমার তখনই হিন্দি সিনেমার প্রতিষ্ঠিত তারকা। অভিনয় শুরু করেছিলেন আর এক ভাই অনুপ কুমারও। অশোক চেয়েছিলেন তাঁর ভাইটাও অভিনয় করুক। কিন্তু অভিনয় নিয়ে কিশোরের তেমন মাথাব্যথা ছিল না। তিনি ক্যারিয়ার শুরু করলেন বম্বে টকিজের কোরাস শিল্পী হিসেবে। বিনোদন দুনিয়ায় পা রেখে বড় দুই ভাইয়ের মতো নিজের নামটিও বদলে নিলেন। আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় থেকে হলেন কিশোর কুমার।
১৯৪৬ সালে অশোক কুমারের ছবি ‘শিকারি’ দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক হলো কিশোর কুমারের। তারপর ১৯৪৮ সালে ‘জিদ্দি’ ছবিতে প্রথমবার গাইলেন গান। তবে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
তার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ফ্লপ। পরে ‘নকরি’, ‘চার প্যায়সে’, ‘বাপ রে বাপ’ ছবিগুলো হিট হলে অভিনয়ের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি। গানটাও কিন্তু চালিয়ে গেছেন এরই মধ্যে। রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ, অমিতাভ বচ্চনের জন্য গাইতেন তিনি। সলিল চৌধুরীর সংগীত পরিচালনায় ‘হাফ টিকিট’ ছবিতে নারী ও পুরুষ দুই কণ্ঠে গান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী ছিলেন রুমা গুহ ঠাকুরতা। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৮ সাল—এই আট বছর টিকেছিল তাঁদের সংসার। ১৯৫২ সালে তাঁদের ছেলে অমিতের জন্ম হয়। এরই মধ্যে মধুবালার প্রেমে পড়েন কিশোর কুমার। ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন এই অভিনেত্রীকে। কিন্তু কিশোরের পরিবার এ বিয়ে মেনে নেয়নি।
কিশোর কুমার একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক। তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনে যদি বেছে নিতে হয়, তবে কোন গানগুলো নেবেন শ্রোতারা? ‘যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে’, ‘আশা ছিল ভালোবাসা ছিল’ নাকি ‘মোর স্বপনের সাথি তুমি কাছে এসো’? সেসব নির্বাচন জটিল কাজ। কেননা, কিশোরের বেশির ভাগ গানই শ্রোতার হৃদয়ের।