বাবনা করিম
বাবনা করিম

ওয়ারফেজের সঙ্গে সেই মুখর দিনগুলো আমি মিস করি: বাবনা করিম

‘অবাক ভালোবাসা’ গানটির চিত্রায়ণ হলো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। আর কোক স্টুডিও বাংলায় নতুন আঙ্গিকে মুক্তি পাওয়া ওয়ারফেজের এই গান আবারও স্মৃতি উসকে দিল শ্রোতাদের। এ প্রজন্মের মানুষজনও মোহিত হলেন গানটিতে। তখনই আবার নতুন করে আলোয় এলেন বাবনা করিম। নব্বইয়ের দশকে ওয়ারফেজের ‘অবাক ভালোবাসা’র মতো বহু গানের স্রষ্টা তিনি। পেশায় প্রকৌশলী এই শিল্পী প্রায় তিন দশক ধরে বাস করছেন মার্কিন মুলুকে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক ই–মেইল সাক্ষাৎকারে এই গানসহ নিজের সংগীতজীবনের ঘর–গেরস্তি মেলে ধরেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মকফুল হোসেন

প্রশ্ন

কোক স্টুডিও বাংলায় ‘অবাক ভালোবাসা’ শুনে নব্বইয়ের শ্রোতারা স্মৃতিতে ফিরছেন। গানটা আপনাকে কতটা স্মৃতিতে ফেরাল?

বাবনা করিম: প্রতিবার গানটা গাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করি; আনমনে হারিয়ে যাই। যেখানেই থাকি না কেন, কক্সবাজারের সেই টিঅ্যান্ডটি রেস্টহাউসের ছাদে ফিরে যাই। সেখানে বুয়েটের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে গানটা লিখেছিলাম। গানটা গাওয়ার সময় রাত, সমুদ্র ও মহাবিশ্বের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করি।

প্রশ্ন

‘অবাক ভালোবাসা’ লেখার গল্পটা আগেও বলেছেন আপনি। এবার আরেকটু বিশদ করে বলবেন?

বাবনা করিম: এটা নিয়ে ফেসবুকেও লিখেছি। তখন আমি বুয়েটের মেকানিক্যাল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম। ১৭ জন বন্ধু মিলে কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়েছিলাম আমরা। আগে কখনোই কক্সবাজারে যাইনি, ফলে ভ্রমণটা মিস করতে চাইনি। এই যাত্রায় আমার কাছের বন্ধু শুভ একটা গিটার নিয়েছিল। কিন্তু লোকে কী ভাববে, তা মনে করে নিজের গিটারটা আমি নিইনি।

মনে আছে, সাতসকালে কমলাপুর স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের ট্রেনে চড়লাম। যাত্রাপথের পুরো সময়টা বন্ধুদের সঙ্গে গান আর আড্ডায় কাটিয়েছি। ট্রেনে নামলাম চট্টগ্রামে, পরে সেখান থেকে সোজা কক্সবাজার। আগে কখনোই সমুদ্র দেখিনি। বঙ্গোপসাগরের কাছে এসে, প্রথমবারের মতো সমুদ্রের গর্জন আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল।

সমুদ্রসৈকত থেকে কয়েক কদম দূরে টিঅ্যান্ডটি রেস্টহাউসে উঠেছিলাম আমরা। সমুদ্রের পাশে রেস্টহাউসের বাইরের ভিউটা দুর্দান্ত ছিল। বিকেলের দিকে বন্ধুরা সব সৈকতে ক্রিকেট খেলতে গেল। রেস্টহাউসেই থেকে গেলাম আমি। গানের সুরটা আগেই মাথায় এসেছিল, লিরিকটা তখনো পাইনি। বারান্দায় বসে শুভর গিটারটা নিয়ে গুনগুন করছিলাম। ওখান থেকে সৈকত, সমুদ্র দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, জীবনটা কী চমৎকার! দুনিয়াটা কী সুন্দর! যেন অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলাম।

রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্যটা ক্রমেই পশ্চিমে হেলে পড়ছিল। সমুদ্রের জলের ঢেউয়ের ওপর ছড়ানো সাদা ফেনার ওপর সূর্যের আলো পড়লে দূর থেকে মুক্তার মতো লাগছিল। তখন পরম আনন্দে চোখ বুজে আসছিল আমার। অসীম মহাবিশ্বের প্রতি কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ওই মুহূর্তেই ‘অবাক ভালোবাসা’ গানের কথা পেয়েছি। প্রতিবার গানটি গাওয়ার সময় আমি চোখজোড়া বন্ধ করি আর প্রতিবারই সেই মুহূর্তে ফিরে যাই।

বাবনা করিম
প্রশ্ন

বলা হচ্ছে, ‘অবাক ভালোবাসা’ সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একটি গান। তিন দশক পর নব্বইয়ের শ্রোতা তো বটেই, এই প্রজন্মের শ্রোতারাও এ গানের মধ্যে নিজেকে খুঁজছেন। গানটির শক্তি আসলে কোথায়?

বাবনা করিম: যেকোনো ধরনের ফলপ্রসূ যোগাযোগের ক্ষেত্রে বার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বার্তা কতটা গভীর, সেটাই মানুষের বিবেচনায় থাকে। ‘অবাক ভালোবাসা’ও এর বাইরে নয়। এই জীবন আমাদের কাছে একটা বিশেষ উপহার, অনেক বড় পাওয়া। আসলে গানটা আমাদের অস্তিত্বের কথা বলে। আমরা দুনিয়াকে অনুভব করতে পারি, ভালোবাসতে পারি—এই গানটা শুনলে জোরালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। আমার ধারণা, এটাই এ গানের মূল শক্তি।

এর বাইরে গানের সুর ও সংগীতায়োজনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর মাধ্যমে বার্তাটা আরও সহজে শ্রোতাদের মর্মে পৌঁছেছে। সে সময় সচরাচর এমন গান হতো না।

প্রশ্ন

ওয়ারফেজের হেভি মেটাল ধাঁচের পাশাপাশি এই ব্যান্ডে থাকাকালে আপনার গায়কিরও নিজস্ব একটা ছাপ পাওয়া গেছে। আপনার গায়কিতে মেলোডিক রক ধাঁচের প্রাধান্য রয়েছে। এই ধাঁচ বেছে নিয়েছিলেন কেন?

বাবনা করিম: এর সঙ্গে হয়তো আমার বেড়ে ওঠার একটা যোগসূত্র আছে। ছোটবেলায় আমি আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত শুনে বড় হয়েছি। এর বাইরে জন ডেনভার, কেনি রজার্স, কার্পেন্টারস, ডন ম্যাকলিন, সাইমন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল শুনতাম। এসব গান আমাকে ভীষণভাবে (মেলোডিক রকে) অনুপ্রাণিত করেছে। পরে হার্ড রক ও হেভি মেটালের সঙ্গে আমার পরিচিতি ঘটেছে।

প্রশ্ন

ওয়ারফেজের সঙ্গে আপনার যাত্রা শুরু কীভাবে?

বাবনা করিম: ওয়ারফেজের প্র্যাকটিস দেখতে প্রায়ই কমলের (গিটারিস্ট) কলাবাগানের বাসায় যেতাম। এর মধ্যে মীর (লিড গিটারিস্ট) উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। তখন গিটারে একটা শূন্যতা তৈরি হয়। আমার চোখে, তখন কমল দুর্দান্ত বেজ গিটার বাজাত। পরে সে ইলেকট্রিক গিটার বাজাতে শুরু করে। ১৯৮৬–৮৭ সালের দিকে ওয়ারফেজে বেজ গিটার বাজানোর সুযোগ পাই।

প্রশ্ন

ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে গেলেন কেন? ওয়ারফেজের সেই দিনগুলো এখন কতটা মিস করেন?

বাবনা করিম: মনেপ্রাণে আমি একজন শিল্পী। কিন্তু প্রকৌশল ও প্রযুক্তিতে আমার দুর্নিবার আগ্রহ ছিল। প্রযুক্তির বিষয়–আশয় বিস্তরভাবে জানতে চেয়েছিলাম আমি। জীবনের কাছ থেকে আরও কিছু গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। তখন আমার সামনে একটা পথই খোলা ছিল, প্রকৌশলকে পেশা হিসেবে আর গানকে প্যাশন হিসেবে নেওয়া।

২৭ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ইউটিলিটি, পাওয়ার প্ল্যান্টস সেক্টরে কাজ করছি। কখনো কখনো আমি অনুভব করি, সংগীত, শিল্প ও দর্শনের প্রতি আরও সময় দেওয়া দরকার। সব সময় সংগীতের সঙ্গে আমার মেলবন্ধন ছিল, কখনোই ছেদ ঘটাইনি। তবে এটা ঠিক, পেশাগত ব্যস্ততার জন্য গানের ব্যাপারটা একটু সমন্বয় করে নিতে হয়েছে।

ঢাকায় ওয়ারফেজের সঙ্গে সেই মুখর দিনগুলো আমি এখনো মিস করি। কিন্তু আগেও বলেছি, গানের সঙ্গে জীবনের কাছ থেকে আরও কিছু চেয়েছিলাম। সেই চাওয়ার পথ ধরেই এখন হাঁটছি। গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ও দর্শনের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ। এর বাইরে আরও গুরুত্বের সঙ্গে সংগীতচর্চাটা চালিয়ে যেতে চাই।

বাবনা করিম
প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ‘আরবিআর’ নামে একটা ব্যান্ড করলেন। সেই ব্যান্ডের গানে ওয়ারফেজের ছায়া থেকে বের হওয়ার একটা চেষ্টা রয়েছে; আপনারা নিউ ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার গান করেছেন। গানের ধারা বদলালেন কেন?

বাবনা করিম: আমি নিরীক্ষা করতে ভালোবাসি। সেই সময়ে ওয়ারফেজ নিরীক্ষাধর্মী গান করে ব্যাপকভাবে সাফল্য পেয়েছে। যদিও সেই সময় শ্রোতারা হেভি মেটাল ও হার্ড রক ধারার গান খুব একটা শুনতেন না। বাইরের কিছু গান শুনতেন। বাংলা হেভি মেটাল ছিল না বললেই চলে। ফলে বাংলা হেভি মেটাল নিয়ে শ্রোতাদের উন্মুখ থাকারও কথা ছিল না। তবে ওয়ারফেজের গান শ্রোতারা ভেঙেচুরে শুনেছে; ভালোবেসেছেন। শ্রোতাদের এই উন্মাদনায় আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম।

‘আরবিআর’–এর গানেও আমরা নিরীক্ষাই করছি। এখানে রোমেল, রাসেল ও আমি ফ্ল্যামেনকো জ্যাজ ধরনের ফিউশন করছিলাম। আমরা ওয়ারফেজের ছায়া থেকে বের হওয়ার জন্য এটা করিনি, নিরীক্ষার অংশ হিসেবে করেছি। কাজটা মূলত করছে রোমেল, গানে ফিউশন ও নিরীক্ষার ছাপ রাখতে চেয়েছে। আমি ও রাসেল শুধু ওকে সমর্থন জুগিয়েছি। আমরা এখনো ক্ল্যাসিক্যাল, কাওয়ালির সঙ্গে ফ্ল্যামেনকো ফিউশন করার চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরও ওয়ারফেজের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আপনাকে পাওয়া যায়। নব্বইয়ের শ্রোতাদের অনেকে এখনো আশায় আছেন, আপনি হয়তো একদিন পুরোদমে ওয়ারফেজে ফিরবেন। কোনো সম্ভাবনা আছে?

বাবনা করিম: আমি কখনোই ওয়ারফেজ ছাড়িনি। যেহেতু দেশে থাকি না, ফলে নিয়মিত ওয়ারফেজের সঙ্গে আমাকে দেখা যায় না, মাঝেমধ্যে অতিথির মতো হাজির হই। যেকোনোভাবেই আমি ওয়ারফেজের পাশে আছি, থাকব। কারণ, ওয়ারফেজ আমাদের সন্তান, আমরা জন্ম দিয়েছি। সামনে আমাদের একসঙ্গে অ্যালবাম করার পরিকল্পনা আছে।

প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে এখন কোথায় আছেন, কী করছেন?

বাবনা করিম: আমি এখন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে বাস করছি। ২৭ বছর ধরে ইউটিলিটি, পাওয়ার ও মাইক্রোগ্রিড সেক্টরে কাজ করছি। এর বাইরে এআই, জেনেটিকস, ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিকস নিয়েও আগ্রহ রয়েছে আমার। এসব নিয়ে পড়াশোনাও করছি। জীবনের কোনো এক সময় হয়তো এসব ক্ষেত্রে যুক্ত হব।

প্রশ্ন

সামনে আপনার নতুন কী গান আসছে?

বাবনা করিম: একটা একক অ্যালবাম নিয়ে কাজ করছি। ওয়ারফেজের আগামী অ্যালবামের গান করছি। এর বাইরে অন্য শিল্পীদের আরও কয়েকটি কাজ রয়েছে। সব মিলিয়ে আমার হাতে বেশ কয়েকটা প্রকল্প রয়েছে। সময় কম, গান করে যেতে হবে।