বছরখানেক পর কনসার্টে ফিরেছে অর্থহীন; এর মধ্যে ‘ফিনিক্সের ডায়েরি ২’ অ্যালবাম নিয়ে আসছে ব্যান্ডটি। ২ অক্টোবর উত্তরার অর্থহীনের স্টুডিওতে প্রথম আলোর সঙ্গে আড্ডা দিলেন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, বেজ গিটারিস্ট, ভোকালিস্ট সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন; যিনি শ্রোতাদের কাছে ‘বেজ বাবা’ সুমন নামে সমধিক পরিচিত। সঙ্গে ছিলেন ড্রামার মার্ক ডন। আড্ডার সূত্রধর ছিলেন মকফুল হোসেন
আপনি বাইরের শিল্পীদের সঙ্গেও নিয়মিত কোলাবোরেশন করছেন। মধ্যে প্রখ্যাত বেজ প্লেয়ার ম্যাগাজিনে আপনাকে নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
সুমন: অনেক দিন অসুস্থ ছিলাম। হঠাৎ আমার পেজে গিয়ে দেখলাম, ‘বেজ প্লেয়ার’ ম্যাগাজিনের এক এডিটর বলেছে, ‘তোমার ইন্টারভিউ নিতে চাই।’ এর আগেও ‘বেজ প্লেয়ার’ ম্যাগাজিনে আমার নাম এসেছিল। এবার ইন্টারভিউটা নিতে চায়। ছোটবেলায় চাঁদা দিয়ে ‘বেজ প্লেয়ার’ ম্যাগাজিন পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে পড়তাম। সেই ম্যাগাজিন আমাকে কাভার করবে, সেটা আমার জন্য বিশাল বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট ছিল। স্টোরিটা প্রকাশের পর স্টুয়ার্ট হ্যামসহ আরও অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছিল।
আমি স্টুয়ার্ট হ্যামের ফ্যান। তাঁর একটি ভিডিও দেখে আমি মিউজিক স্ল্যাপ শিখেছি। তিনি আমার মেন্টর। স্টিভ হ্যারিসকে দেখে আমি বেজ বাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। স্টুয়ার্ট হ্যামকে দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি স্ল্যাপ বাজাব। তাঁকে নিয়ে একটা ইনস্ট্রুমেন্টাল করেছিলাম। পরে ন্যাম শোতে (সংগীত প্রযোজক, মিউজিশিয়ানদের আসর) দেখা হয়েছিল, তাঁকে ওটার সিডিটা দেখিয়েছিলাম। পরে তিনি আমাকে ই–মেইল করেছিলেন। আমি ওকে লিখেছিলাম, কখনো সুযোগ পেলে আমরা কোলাবোরেশন করব। তাঁকে ইনস্ট্রুমেন্টাল পাঠিয়ে রেখেছিলাম।
১৩ মাস পর তিনি আমাকে ইনস্ট্রুমেন্টালটা পাঠান। ওটা আমি শুনতেছি আর কাঁদতেছি। আমার ইনস্ট্রুমেন্টালে স্টুয়ার্ট হ্যাম বাজিয়েছে। এর চেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট আর কী হতে পারে। ওর একটা অ্যালবামের দুটি গান কো-প্রডিউস করেছি। এরপরে মিউজিকে আর কী চাইতে পারি।
আপনি যখন বেজ বাজানো শুরু করলেন, তখন ব্যান্ড সংগীতে বেজ গিটার খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বেজ গিটারে আগ্রহী হলেন কেন?
সুমন: স্টিভ হ্যারিসকে দেখে আমার মনে হলো, বেজ বাজিয়ে ফাটিয়ে ফেলতে হবে। বয়স কম ছিল, খুব দ্রুত বাজাতে হবে। আমার ইচ্ছা ছিল, দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির বেজিস্ট হব। আমি সেকেন্ডে ১৪টার মতো নোট বাজাতে পারছিলাম। আমি বেজকে ভালোবাসি। এখন আমি গান গাই, মানুষ গায়ক হিসেবে চেনে। কিন্তু এখনো আমি নিজেকে বেজ প্লেয়ার হিসেবেই চিন্তা করি। আমি প্রথমত একজন বেজ প্লেয়ার, দ্বিতীয়ত গীতিকার, তৃতীয়ত ভোকালিস্ট, চতুর্থ সুরকার, পঞ্চমত মিউজিক প্রডিউসার।
এখন আমি গান গাই, মানুষ গায়ক হিসেবে চেনে। কিন্তু এখনো আমি নিজেকে বেজ প্লেয়ার হিসেবেই চিন্তা করি।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
এই সময়ে এসে একজন বেজ প্লেয়ারকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়; বেজ প্লেয়ারদের ভূমিকা কতটা পরিবর্তন হলো?
সুমন: বেজটাকে মানুষ এখনো সেভাবে জড়িয়ে ধরেনি, যতখানি জড়িয়ে ধরা উচিত ছিল। কারণ, একসময় এসে ড্রামস ও বেজ কি-বোর্ডে দেওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। কি-বোর্ডেই বেজ বাজিয়ে ফেলা যায়। ফলে ড্রামার ও বেজিস্টরা বড় একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। এই কারণে বেজটা অতটা বাড়তে পারেনি।
তবে ভোকালিস্ট পরিচয়ে বেজিস্ট পরিচয়টা অনেকটা আড়ালে চলে গেছে...
সুমন: এখন জিনিসটা যতখানি আছে, সেটা তার চেয়ে আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু আমি গান গাইছি, সেহেতু বেজ নিয়ে আর উঠতে পারিনি। কারণ, সবাই আমার গান শোনা শুরু করেছে। কিন্তু আবার ভোকালিস্ট হিসেবে যতখানি নাম কামিয়েছি, সেখানে বেজও আছে। কারণ, কনসার্টে গিয়ে বেজ নিয়ে কিছু না কিছু একটা করছি। তুমি যত যা-ই বলো, আমি বেজিস্ট।
জীবনে আপনার আর চাওয়ার কী আছে?
সুমন: এক. ছেলেমেয়ে যাতে ভালো, সুন্দর ও নিরাপদ একটা জীবন পায়, সেটা আমি প্রায় করে ফেলেছি। আমার একটা রোড ট্রিপ দেওয়া বাকি আছে। দুই. ইংল্যান্ড থেকে নদার্ন আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত রোড ট্রিপ দেব। আমি ছবি তুলতে ভালোবাসি। ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি করব। যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটা রোড ট্রিপ দেওয়া বাকি আছে।
তিন. ‘ফিনিক্সের ডায়েরি ২’ অ্যালবাম রিলিজ দেব। চার. ফ্যানদের জন্য আরও ছয়টা কনসার্ট করব। এ ছাড়া আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। এগুলো শেষ হয়ে গেলে আমি যে কী করব, সেটা নিয়ে টেনশনে ঘুমাতে পারছি না। আমি আর কিছু চাই না। আমি না চাইতেই অনেকের দোয়া, আশীর্বাদ পেয়েছি।
এর মধ্যে ‘ফিনিক্সের ডায়েরি ২’ অ্যালবামের কাজ করছেন। অ্যালবামে কী থাকবে?
সুমন: কী থাকবে, সেটা এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।
সম্প্রতি মহান ফাহিম অর্থহীন ছেড়েছেন। অর্থহীনের যাত্রার পর থেকে একের পর এক সদস্য এসেছে, আবার চলেও গেছে। তবু অর্থহীন নিজের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে টিকে আছে।
সুমন: এটার মূল কারণ হলো, অর্থহীনের বেশির ভাগ গান লিখি ও সুর করি আমি। মিউজিক বাজাচ্ছে তরুণেরা। তাদের জোশ আইডিয়া আছে। তবে গানের লেখা ও সুরটা আমার। যেই কারণে ছেদ পড়ছে না। আমি যত যা-ই করি না কেন, আমি জানি কীভাবে মিউজিক করতে হয়। আমি মিউজিশিয়ানদের স্বাধীনতা দিই। ‘নিকৃষ্ট ৩’ গানটা মার্ক ডন বানিয়েছে, আরেকটা গান বানিয়েছে শিশির। এই জন্য আমাদের ব্যান্ড চলতে থাকে। আমি যদি চিন্তা করি, আমিই সব বানাব, তাহলে আমরা ডাইনোসর হয়ে যেতাম।
অর্থহীনের লাইনআপ নিয়ে কী পরিকল্পনা?
সুমন: আমাদের ব্যান্ডের তিনজন সদস্যই থাকবে। এর মধ্যে আমি ও মার্ক ডন স্থায়ীভাবে আছি। মার্ক এই ব্যান্ডের সেকেন্ড ইন কমান্ড। আমি যখন আনঅ্যাভেইলেবল থাকি, মার্কই তখন ব্যান্ড লিডার। আমার সঙ্গে কথা বলে মার্কই সিদ্ধান্ত নেয়, আবার কখনো আমার সঙ্গে কথাও বলতে হয় না। নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জাহিনকে আপাতত স্থায়ী বলছি না। কিছু একটা রি-অর্গানাইজ করছি।
আলাদাভাবে ব্যান্ড সংগীতের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এখনো স্বীকৃতি মেলেনি কেন, গ্যাপ কোথায় দেখছেন?
সুমন: সোনার বাংলা সার্কাসও ব্যান্ড মিউজিক করে। তারা খুবই ভালো করছে। তাদের গানের কথা সুন্দর। পাওয়ার সার্জ জোশ গান করতেছে। ওউন্ড-ও জোশ গান করছে। এখন যদি সোনার বাংলা সার্কাস, পাওয়ার সার্জ ও ওউন্ডের গান পাশাপাশি রাখি, তিনটাই ব্যান্ড মিউজিক। এখন ব্যান্ড মিউজিককে সরকার কোন গান শুনে স্বীকৃতি দেবে? ব্যান্ড মিউজিক কোনো অবস্থাতেই জনরা হতে পারে না। আমাদের দরকার, বাংলাদেশের ব্যান্ডগুলো যে জনরার মিউজিক করতেছে, ওই রকম বাংলাদেশি জনরা দরকার। এটা মেগা ডেথের মতো একটা বাংলা গান নয়, কোল্ডপ্লের মতো একটা বাংলা গান চাই না। আমি বাংলাদেশের মতো একটা বাংলা গান চাই। আমাদের আলাদা জনরা হওয়া উচিত।
আমাদের একটাই দোষ, নিজেরা নিজেদের জনরা বানাতে পারছি না। ভারতের ইন্ডিয়ান ফোক মেটাল জনরা আছে, আমাদের কেন জনরা থাকবে না? আমরা কিছু করতে পারলে, সরকারের কাছে গিয়ে বলতে পারব, আমাদের জনরা আছে; সেই জনরাকে স্বীকৃতি দাও। জনরার স্বীকৃতি হয়ে গেলেই মিউজিকের পাঠ্যক্রমে বলা হবে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত আছে, নজরুলগীতি আছে, লালনগীতি আছে, সঙ্গে বাংলা রকও আছে। অথবা বাংলা ফোক মেটাল আছে। তখন মিউজিক আরও বেশি রিচ হবে। ব্যান্ডরা কোল্ডপ্লের দিকে ফোকাসড হবে না। তখন বাংলাদেশি ব্যান্ডগুলোর দিকে ফোকাস হবে। ওই জনরাতে গান বাড়তে থাকবে। পরের প্রজন্মের মিউজিয়ানদের লাভ হবে।
মেগা ডেথের মতো একটা বাংলা গান নয়, কোল্ডপ্লের মতো একটা বাংলা গান চাই না। আমি বাংলাদেশের মতো একটা বাংলা গান চাই। আমাদের আলাদা জনরা হওয়া উচিত।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। ব্যান্ড সংগীত অঙ্গনে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন দেখছেন?
সুমন: বিগত সরকারের সময় বেশ কিছু ফ্রি কনসার্ট হয়েছে। ফ্রি কনসার্ট মানুষের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ফ্রি কিছু দিলে মানুষ সেটাকে অধিকার মনে করতে থাকে। এখন অ্যালবাম বিক্রির কোনো উপায় নেই। স্ট্রিমিং চলে এসেছে। স্ট্রিমিংয়েও সাবস্ক্রাইব করে ওইভাবে গান শোনে না। ইউটিউবের ভিউ থেকে কয় টাকা পায়? সেটা দিয়ে পেট চলবে না। মূলত কনসার্ট থেকেই মিউজিশিয়ানরা টাকা পায়। ফ্রি কনসার্ট পেয়ে মানুষের ফ্রি ঢোকার স্বভাব হয়েছে। এটাকে ভাঙতে হবে। ফ্রি কনসার্ট থেকে দূরে সরে আসতে হবে।
কোনো কিছুই ফ্রি না। এটা যদি না থামে, একটা মিউজিশিয়ান যদি কনসার্ট করেও টাকা কামাতে না পারে, তাহলে একটা মানুষ কী থেকে টাকা কামাবে? সবকিছু ছেড়ে দেখা গেল, মিউজিশিয়ানরা অমুক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছে। অথচ সেই মিউজিয়ান হয়তো বা গ্র্যামি জিততে পারত। আমরা নাহয় বছরে পাঁচটা কনসার্ট করি। অন্যরা যারা কনসার্ট করে চলে, ওদের কী অবস্থা এখন? ওরা না খেয়ে মরছে, এদের কী হবে? এই জিনিসটা থামাতে হবে। সরকারকে এই জায়গায় চোখ দিতে হবে। এটা সংস্কার করলে অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে যাবে।
বিগত সরকারের সময় বেশ কিছু ফ্রি কনসার্ট হয়েছে। ফ্রি কনসার্ট মানুষের মাথা খারাপ করে দিয়েছে। ফ্রি কিছু দিলে মানুষ সেটাকে অধিকার মনে করতে থাকে।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
মার্ক ডন, আপনি তো অল্প বয়সে অর্থহীনে যুক্ত হয়েছেন। অর্থহীনে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
মার্ক ডন: ২০০৮ সাল থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডে মিউজিক করতাম। আমি ট্রেইনরেক ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আমি ড্রামস বাজাতাম। একদিন জানলাম, অর্থহীন গেস্ট ড্রামার খুঁজছে। আমি একটা কনসার্ট করেছিলাম বুয়েটে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি অর্থহীনের আরেকটা কনসার্ট ‘রক নেশন’ করি। এরপর সুমন ভাই কিছু কোলাবোরেশন করেন। এর মধ্যে সুমন ভাই আমাকে অর্থহীনে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কোনো চিন্তা ছাড়াই আমি বলেছিলাম, ‘অবশ্যই যোগ দেব।’ তারপর নয় বছর ধরে আমি অর্থহীনে। অর্থহীনের থাকার অভিজ্ঞতাটা দারুণ।