‘ছবি ও সুরের মিশেল’, কথাটি যত সহজে বলা গেল, বিষয়টা তত সহজ নয়। এতে এক মাধ্যমে প্রকাশিত শিল্পীর অনুভূতি ভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপনার মুনশিয়ানা বিবেচনায় আসে। তেমনই একটি ঘটনা ঘটল ১৩ জুলাই লন্ডনে অভিজাত শিল্পকেন্দ্র রয়্যাল অ্যালবার্ট হলের এলগার রুমে। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কবি টি এম আহমেদ কায়সার। প্রযোজনায় যৌথভাবে রয়াল আলবার্ট হল এবং আহমেদ কায়সারের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিক।
আলো-আঁধারি পরিবেশে বিশ্বখ্যাত ভারতীয় শিল্পী বিদুষী কালা রামনাথের ক্রন্দসী বেহালায় শাস্ত্রীয় সুরের মূর্ছনা বুঁদ করে রেখেছিল হলভর্তি শ্রোতাদের। সেই সঙ্গে পর্দায় প্রক্ষেপিত হলো মেক্সিকোর চিত্রকর ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকর্ম। সব মিলিয়ে হৃদয়াবেগ, কলাশৈলী ও উৎকর্ষতার এক চূড়ান্ত প্রদর্শনী। শিল্পকলার দুই মাধ্যমের এক অপূর্ব যোজনা দর্শকদের বিনোদনের ভাসমান জগতে নিয়ে যায়।
অনুষ্ঠানের পর কথা হচ্ছিল পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সারের সঙ্গে। জানতে চাই, বিমূর্ত ও সাকার—এমন দুই মাধ্যমের একটির ভাব কীভাবে অন্যটিতে অভিব্যক্ত করা সম্ভব?
আহমেদ কায়সার বললেন, ‘শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ আমরা আলাদাভাবে মোটাদাগে দেখি। সংগীত বা চিত্রকলা তেমনি তাদের নিজস্বতা দিয়ে আমাদের আক্রান্ত করে। আবার প্রতিটি শিল্পকর্মের মধ্যেই অনুভূতি, আবেগ বা চিন্তনের কিছু সূক্ষ্ম বিষয় থাকে। যে সূক্ষ্মতাগুলো একে অপরের ব্যাখ্যায় বা উপস্থাপনায় সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া শিল্পকলার জগৎ হচ্ছে আকাশের মতো। আকাশের কোনো বিভাজন নেই, বিভক্তি নেই। আলাদা আলাদা শিল্পের গভীর এবং দার্শনিক আত্মীয়তা দিয়েই রচিত হয় শিল্পের আকাশ। আমরা, শিল্প উপভোগকারীরা একাধিক শিল্পমাধ্যম নিয়ে সেই আকাশেই অভিসার করতে চাই। এক শিল্প যে অন্য শিল্পের আত্মীয়, সেই সংযোগ রচনা করতে চাই আর সেই অভিসারের মধ্য দিয়ে শিল্প-ভোক্তাদের আবেগকে আরও গভীরভাবে নাড়া দিতে চাই। আলোচ্য অনুষ্ঠানই হয়তো এর উদাহরণ।
অনুষ্ঠানের ১০-১২ দিন পরও নানা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের এখনো উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া, এমন অসামান্য কাজ যত বেশি হবে, ততই মানুষের নতুন করে দেখার প্রবণতা বাড়বে। অনুষ্ঠানের জন্য বেছে নিয়েছিলাম মেক্সিকোর চিত্রকর ফ্রিদা কাহলোর জীবন ও চিত্রকর্মের সঙ্গে উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীত। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দুটি একটি আরেকটির সম্পূরক। আবেগের দিকটাও এক রকম। তাই দুটির মধ্যে মেলবন্ধন হওয়া সম্ভব এবং তা-ই হয়েছে পুরো অনুষ্ঠানে। দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন করতে চেয়েছি। ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্মের নতুন ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি। এই পুরো বিষয়ের জন্য ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদার কাছে ঋণী, যিনি কোনো রচনার ব্যাখ্যা/পুনর্ব্যাখ্যার এক নতুন ধারণা দিয়েছেন। এখানে মজার ব্যাপার হলো, পুনর্ব্যাখ্যা নানাভাবেই এক বহুরৈখিক অর্থ-দ্যোতনা তৈরি করছে। আমার অনুষ্ঠানে কাহলোর শিল্পকর্মের আবেগ বা অনুভূতি উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সুরে আরও নতুন আবেগ বা আবেদন তৈরি করছে। তেমনই বিদুষী কালা রামনাথের বাজানো কিছু হৃদয়স্পর্শী রাগ ফ্রিদার চিত্রকর্মের সহায়তায় নতুন নতুন মাত্রা এবং অর্থ তৈরি করেছে।’
আহমেদ কায়সারের কাছে আবার জানতে চাই, আপনার এই অনুষ্ঠানের উপজীব্য কি ব্যক্তি ফ্রিদা কাহলোর মনোবেদনা, নাকি তাঁর শিল্পকর্মে প্রকাশিত আবেগকে ভিন্নতর মাধ্যমে উপস্থাপনা?
বললেন, ‘আগেই যেমন বলেছি, শিল্পকলার পৃথিবী কেবলই আকাশ, সেখানে সবকিছুই এক হয়ে যেতে পারে। আবার বিজ্ঞানে শক্তির নিত্যতার সূত্র অনুযায়ী শক্তি বা বস্তুর কেবল রূপ বদল করা সম্ভব। সেই নিরিখে শিল্পকলায়ও সব অর্থে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ, বরং আমরা রূপান্তর ঘটাতে পারি। দীর্ঘদিন একই ঐতিহ্য মেনে একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি মাঝেমধ্যে মনের ভেতর অজান্তেই এক বিকর্ষণবোধের সঞ্চার করে। আমি মনে করি, একাধিক শিল্পের পরিমিত এবং বুদ্ধিভিত্তিক অভিসারে যে অপূর্ব যৌগ শিল্প রচিত হয়, তা বরং নতুন আবেদন বা উপযোগ তৈরি করে।’
অনুষ্ঠানে দুই রকম শ্রোতা এসেছিলেন, কেউ উচ্চাঙ্গসংগীতের শ্রোতা, কেউ আবার ভালোবাসেন চিত্রকলা। অনুষ্ঠানের পর চিত্রকলার সমঝদার উচ্চাঙ্গসংগীতেরও ভক্ত হয়ে গেলেন। আর সংগীতশ্রোতা পেলেন আত্মমগ্ন হয়ে ওঠার নতুন বিষয়। কিন্তু কাউকে তাঁর মূল পছন্দ থেকে বিচ্যুত হতে হলো না।
অনুষ্ঠান শেষে একজন কোরীয় দর্শক বলেছেন, তিনি ফ্রিদার চিত্রকর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত, এর আগে তিনি কোথাও উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত তো নয়ই, রবি শঙ্করের নাম পর্যন্তও শোনেননি। এই অনুষ্ঠানের পর এই মহান সংগীত নিয়ে আরও বেশি করে জানতে চান, আরও বেশি শুনতে চান। তাঁর কথা শুনে মনে হলো, ১৩ বছর আগে বিলাতি নানা সংস্কৃতির মানুষের কাছে উপমহাদেশের ধ্রুপদি সংগীত প্রচারের জন্য যে সৌধ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সে কাজটা এগিয়ে নিতে পেরেছি।
প্রশ্ন করি, অনেক শিল্পীই বেদনার বা কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। যেমন ভ্যান গঘ। ফ্রিদাকে বেছে নেওয়ার কারণ কী?
আহমেদ কায়সার বললেন, প্রত্যেক শিল্পীর জীবন এবং শিল্পকর্ম আলাদা। তাঁরা তাঁদের কষ্টের প্রকাশ ঘটিয়েছেন বিভিন্নভাবে। যেমন আইজ্যাক লেভিটন কোনো দিন কোনো প্রাণীর ছবি আঁকেননি। কিন্তু শেষ ছবিটা আঁকলেন ভোলগার তীরে এক শীতার্ত ঘোড়ার। ঘোড়াটা আসলে তিনি নিজেই। ফ্রিদা আর অন্য কোনো প্রতীকের আশ্রয় নেননি। নিজেকেই এঁকেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম যেন তাঁর একান্ত আত্মজীবনী। নিজেকে এত নগ্নভাবে খুলে দেওয়ার সাহসিকতা শিল্প-ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এখানে অবশ্য আমার ব্যক্তিগত পছন্দও সমানভাবে কাজ করেছে।
প্রশ্ন: অনুষ্ঠানের উপক্রমণিকায় আপনি ফ্রিদার ছোটবেলায় পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার কথা, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ায় ৩৪টি জটিল শল্য চিকিৎসার কষ্ট এবং প্রেমিক স্বামীর প্রতারণার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ফ্রিদা নিজেও স্বামীকে প্রতারণা করেছেন। ট্রটস্কির সঙ্গে প্রেম করেছেন নিজের বাড়িতেই। তাই মনে হয়, ফ্রিদার কষ্টটা স্বামী দিয়েগোকে নিয়ে নয়, নিজের বোনের সঙ্গে ঈর্ষার জ্বালা...
আহমেদ কায়সার: এই জায়গায় আমরা পরিষ্কার কিছু বলিনি। কষ্টের কারণের দিকে আমরা খুব মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে কষ্ট বা দহনটাকে দেখেছি এবং তাঁর দহনের চরিত্রায়ণের জায়গাতেই স্থির থেকেছি।
প্রারম্ভিকায় আহমেদ কায়সার নিজের জীবনের অবসাদ ও বিমর্ষতা থেকে পরিত্রাণ খোঁজার জন্য শিল্পের রূপ-রস-গন্ধে বিভোর থাকার কথা বলেন। সেই বোধ থেকে একাধিক শিল্পের মিথস্ক্রিয়ায় যৌগ শিল্প রচনায় ঝুঁকি ছিল। তা কৃত্রিম মনে হতে পারত, হয়নি। তাঁর এই সংগীতালেখ্য একটি অনন্য শিল্পকর্ম হিসেবেই সার্থক হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিদুষী কালা রামনাথের সঙ্গে তবলা সংগত করেন পণ্ডিত সাঞ্জু সাহাই। বৈষ্ণব ধারার অন্যতম কবি রাধারমণ দত্তের বিখ্যাত গান ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো’ পরিবেশন করেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি শিল্পী শাপলা সালিক। ফ্রিদার আত্মকথন পাঠে ছিলেন শ্রী গাঙ্গুলি। ভিডিও গ্রন্থনা করেন মেধাবী চিত্রনির্মাতা মকবুল চৌধুরী। নেপথ্য ব্যবস্থাপনায় ছিলেন শামীম শাহান ও রুহুল আমিন চৌধুরী।