শাফিন আহমেদ জীবনের শেষ দিনগুলোয় ছিলেন মাইলসের বাইরে
শাফিন আহমেদ জীবনের শেষ দিনগুলোয় ছিলেন মাইলসের বাইরে

মাইলস নিয়ে শাফিন আহমেদের যে অভিমান

প্রতিষ্ঠার প্রায় শুরু থেকেই দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘মাইলস’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন শাফিন আহমেদ। দলের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়। অভিমান করে দল ছেড়ে চলে যান। আবার ফেরেনও। সবশেষ চূড়ান্তভাবে দল ছেড়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় ছিলেন মাইলসের বাইরে। নিজের মতো সংগীতচর্চা করেন। মাইলস ছাড়াই দেশ-বিদেশে কনসার্টে অংশ নেন। জীবনের শেষ কনসার্টেও ছিলেন মাইলসবিহীন।
২০১০ সালের শুরুর দিকে একবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ব্যান্ড থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। শাফিন আহমেদ নামেই যাত্রা করেন। কয়েক মাস পর দ্বন্দ্ব ভুলে আবার এক হন। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালে অক্টোবরে তিনি আবারও মাইলস ছেড়ে দেন। সবশেষ, অর্থাৎ তৃতীয়বার মাইলস ছেড়েছেন ২০২১ সালের নভেম্বরে।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসের কথা। মাসের শেষ শনিবার দিবাগত রাতে নিজের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোস্ট করেন শাফিন আহমেদ।

সেই ভিডিওর সূত্রে বিভিন্ন পোর্টাল ও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়, আবারও মাইলস ছাড়ছেন এই শিল্পী। সেখানে তিনি বলেছেন, কেন মাইলসের বর্তমান লাইনআপের সঙ্গে কাজ করতে চান না তিনি। পরে প্রথম আলোর ফেসবুক লাইভে বলেছেন, ‘আমি বলিনি মাইলস ছেড়ে দিয়েছি।’ মাইলস নিয়ে নিজের অভিমান, কষ্টের কথা বলেছিলেন শাফিন আহমেদ।

সেবার লাইভে শাফিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমি বলেছি এখনকার মাইলস সদস্যদের সঙ্গে আমার আর মিউজিক করার ইচ্ছা নেই। মাইলস ছেড়ে দেওয়া অন্য অর্থ বহন করে। আমি সে কথা বলিনি। মাইলস আমার হাতে গড়া ব্যান্ড। আমার বহু কষ্টের ফলে মাইলস এই জায়গায় অবস্থান করছে। মাইলস ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সবার সঙ্গে মিউজিক করা যায় না। মিউজিক একটা পবিত্র কাজ। একসঙ্গে কাজ করতে গেলে একসঙ্গে অনেক সময় কাটাতে হয়। কিন্তু যেখানে মনের মিল একেবারেই নেই, সেখানে সংগীত করা সম্ভব নয়। আমি সরে থাকতে চাই, কিন্তু আমার সংগীতকর্ম থেমে থাকবে না।’

শাফিন আহমেদ

ব্যান্ডের কার্যক্রম বন্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এই দলের পেছনে আমার শ্রম ও অবদান রয়েছে। আমি এর সুনাম ও ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছি। আমার সঙ্গে মীমাংসা না করে সেই সুবিধাগুলো তারা ব্যবহার করবে, সেটা ভালো দেখায় না।’

এ ছাড়া সাক্ষাৎকারে শাফিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে নানা বিষয় নিয়ে ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি চলছিল। তখন তাঁর ভাষ্য ছিল এমন, ‘এত দিনে সেসবের সমাধান হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। ২০১৭ সালে এ নিয়ে কথা উঠেছিল। অনেকবার চেষ্টা করেও সেসবের কোনো অগ্রগতি হয়নি। সেসবের মধ্যে কিছু বিষয় আইনি, কিছু আর্থিক। দলের সদস্যদের মধ্যে আচার-ব্যবহার দুর্ব্যবহারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যা খুলে বলা প্রায় অসম্ভব। নিজের মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে, সবকিছু ঠিক আছে, এ রকম অভিনয় করে তাদের সঙ্গে মিউজিক করে যাওয়া, স্টেজ বা রেকর্ডিংয়ে অংশ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যায় ও অনিয়মের প্রতিবাদ আমার নেচারের মধ্যে রয়েছে। সেসবের স্বাভাবিক সমাধান না হলে আমার আইনের সহায়তা নিতে হবে।’

সেদিন ছিল প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে ‘লাক্স ক্যাফে লাইভ: পর্ব ৬৩০’, অতিথি হিসেবে এসেছিলেন শাফিন আহমেদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার কবির বকুল।

মাইলস

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল শাফিন আহমেদের জন্মদিন। চলতি বছর জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলো বিনোদন বিভাগ শাফিন আহমেদের সাক্ষাৎকার নেয়। নিজের সাম্প্রতিক কাজ, পরিকল্পনার বাইরে এই সাক্ষাৎকারে মাইলস নিয়েও কথা বলেন তিনি। সেদিনও মাইলস নিয়ে তাঁর কথায় অভিমান ছিল স্পষ্ট। শাফিন আহমেদের ভাষ্যে, ‘৪০ বছর ধরে মাইলস ব্যান্ডের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তিন বছর আগে আমাকে মাইলস থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেটার সঠিক সমাধান আমি এখনো খুঁজে পাইনি। পরে আমি শাফিন আহমেদ নামেই যাত্রা করেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম মাইলস নামটা যেন আর ব্যবহৃত না হয়। একটি ব্যান্ড সম্মানিত জায়গায় পৌঁছার পর সেটি আর সমালোচনার মুখে না পড়ুক। সেই জায়গা থেকেই আমার চাওয়া ছিল, আমরা যেন কেউই মাইলস নামটা ব্যবহার না করি।’

মাইলসের সঙ্গে প্রায় ৪০ বছরের পথচলায় অসংখ্য জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন শাফিন আহমেদ। তাঁর গাওয়া ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ্বালা জ্বালা অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও হারানো প্রেম’,‘পাহাড়ি মেয়ে’ গানগুলো বছরের পর বছর জনপ্রিয়তার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। গান, মাইলস, গিটার সব ছেড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। ৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন শাফিন আহমেদ। একটি কনসার্টে গানও পরিবেশন করেন। ২০ জুলাই ভার্জিনিয়াতে তাঁর আরেকটি স্টেজ শোতে পারফর্ম করার কথা ছিল। সেদিন অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বনানী কবরস্থানে বাবার কবরে সমাহিত করা হবে শাফিন আহমেদকে। পাশে তাঁর মা সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের কবর রয়েছে।