শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন পয়লা মে পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। মে দিবস নিয়ে বিশ্বের প্রায় সব ভাষায়, সব দেশে লেখা অনেক গান, কবিতা। সংগীতশিল্পীরা গেয়েছেন প্রচুর গান। বাংলা ভাষায় শ্রমিকদের নিয়ে কোনো গানের কথা এলেই সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে জন হেনরি গানটির কথা। আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বারবার একজনের গান সামনে আসছে। তিনি ফকির আলমগীর। গাইছেন, নাম তাঁর ছিল জন হেনরি/ ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন/ হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী/ খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন...।
গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা ও সুরে গানটি নানা সময়ে গেয়েছিলেন বাংলাদেশের গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। আজ ১ মে তাঁকে বারবার স্মরণ করছেন ভক্তরা। শ্রমিকের অধিকারের গান, শ্রমিকের প্রাণ জুড়ানোর গান করতেন ফকির আলমগীর। মে দিবস এলে তাঁকে মনে পড়বেই। বাংলাদেশে গণসংগীতকে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আর অন্য রকম সম্মান দিয়েছিলেন, ফকির আলমগীর তাঁদেরই একজন। বছরের পর বছর পয়লা মে তিনি সক্রিয় ছিলেন, কণ্ঠে ধরেছিলেন শ্রমজীবী মানুষের গান। বছর তিনেক আগেও তিনি ছিলেন। আজ তিনি নেই। রয়ে গেছে তাঁর গান, তাঁর সৃষ্টি।
ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন, ‘মানুষের মাঝে বসবাস করি / মানুষে মিলেছে ঠাঁই/ মানুষ আমার সুজন–স্বজন মানুষের গান গাই।’ ফকির আলমগীর কি শুধুই গাইতেন? না, শ্রমজীবী মানুষের জন্য তিনি কলমও ধরেছিলেন। এই দিক থেকে যেকোনো শিল্পীর চেয়ে তাঁর সক্রিয়তা ছিল অনন্য।
এই তো, ২০২১ সালের মে মাসের কথা। সাভারের রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য তিনি লিখেছিলেন দৈনিক পত্রিকায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘সাভারের রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কান্না আজও থামেনি। এ ছাড়া তাজরীন ফ্যাশনসসহ বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা আজও প্রয়োজনীয় সহায়তা পাননি। এসব অসহায় মানুষ যেন ন্যায্য অধিকার ফিরে পান, এটাই আমার সব সময়ের আরজি। আর মে দিবস শুধু আনুষ্ঠানিকতাই নয়, এটি আজ চরম বাস্তবতা। মে দিবস এক চেতনার মশাল। এই মশালে আমরা আজও উজ্জীবিত। নুসরাত, এফআর টাওয়ার, পুরান ঢাকার আগুন, এগুলো লোভ-লালসার আগুন। এই বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যত দিন বৈষম্য–অনাচার থাকবে, তত দিন মে দিবস থাকবে। আমাদের কণ্ঠ জেগে থাকবে। সচেতনতা শুধু শ্রমিকদের নয়, সবার সচেতন হওয়া দরকার। কেন দুঃখী, দরিদ্র মানুষই শুধু তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে? কেন সামাজিক, রাজনৈতিক শক্তি তাদের পাশে দাঁড়ায় না? মে দিবস সেই সচেতনতায় উদ্বুদ্ধ করে।’ গানে গানে তিনি এসব মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন, ‘বাংলার কমরেড বন্ধু এইবার তুলে নাও হাতিয়ার/ ভূমিহীন কৃষক আর মজদুর/ গণযুদ্ধের ডাক এসেছে।’
গণমানুষের প্রাণের গান গাইতেন তিনি। শ্রমজীবী মানুষের প্রাণের কান্না, হাসি, আকুতির কথা শোনা যেত সেসব গানে। ধরা যাক ‘ও সখিনা গেছস কি না ভুইলা আমারে’ গানটির কথা, যেটি মূলত এক রিকশাচালকের হৃদয়ের আকুতি। যেখানে সখিনাকে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আমি অহন রিশকা চালাই ঢাকা শহরে।’ কিংবা ‘মোর সখিনার কপালে টিপ’সহ গানগুলোয় শ্রমজীবী মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবেন।
ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণ শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছেন ফকির আলমগীর। গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন গান দিয়েই। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে পুঁজি করে দেশি সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধনে তিনি ও সমসাময়িক কয়েকজন শিল্পী শুরু করেছিলেন প্রথম বাংলা পপ ধারার গান।
সেই ধারার বিকাশে ফকির আলমগীরের রয়েছে বিশেষ অবদান। তাঁর কণ্ঠে ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘কালো কালো মানুষের দেশে’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ও সখিনা গেছস কি না ভুইলা আমারে’ গানগুলো কখনোই ভোলার নয়। তেমনি বাংলা নতুন বছরের প্রথম প্রহরেও ফকির আলমগীরকে মনে করবে বাঙালি। দীর্ঘ ৪৫ বছর একজন সংগঠক হিসেবে ঋষিজ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাল ধরে ছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সাল থেকে পয়লা বৈশাখের সকালে রাজধানী শাহবাগের নারিকেলবীথি চত্বরে নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করে। নাচ–গানসহ নানা আয়োজনে অগণিত মানুষের উপস্থিতিতে জমে ওঠে তাঁদের আয়োজন।
২০২১ সালের ১ মে মাসে গান করে ২৩ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ফকির আলমগীর। রেখে গেছেন নানা কীর্তি, যা বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গন কখনোই ভুলতে পারবে না।