শহরতলী ব্যান্ডের সদস্যরা
শহরতলী ব্যান্ডের সদস্যরা

বিপ্লবে–প্রতিবাদে শহরতলীর ২০ বছর

ভক্তরা মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে নতুন ধারা এনেছে ‘শহরতলী’। এ ধারাকে বলা হচ্ছে ‘থিয়েট্রিক্যাল রক’, অর্থাৎ কবিতা, সংগীত ও সুরকে একবিন্দুতে এনে একটা ভিন্ন আবহ তৈরি করা। ২০০৪ সালে এ ধরনের গান নিয়ে কাজ শুরু করে শহরতলী। ব্যান্ডটি তাদের পথচলার ২০ বছর পার করেছে গত ৬ অক্টোবর। ২০ বছর পূর্তিতে ২২ নভেম্বর প্রকাশ পাচ্ছে ব্যান্ডটির নতুন গান ‘আরেকটি প্রহর’।
শুরুটা যেভাবে
সময়টা ২০০৪। ঢাকা কমার্স কলেজের তিন বন্ধু মিশু খান, গালিব আজিম ও বিদ্যুৎ রহমান মিলে একটি ব্যান্ড গঠনের চিন্তা করেন। আলাদা আলাদা মিউজিক করলেও একসঙ্গে কিছু একটা করার তাড়না থেকে জন্ম নেয় ব্যান্ড ‘শহরতলী’। কিন্তু তিনজনে তো ব্যান্ড হয় না, তখন সেখানে বেজিস্ট হিসেবে যুক্ত হয় তপন মাহমুদ, যাঁর আবার গান লেখার হাত আছে। এরপর ড্রামার হিসেবে যোগ দেন সানী। এভাবেই শুরু করে ব্যান্ডটি। তবে ২০১১ সালে ব্যান্ডটির প্রথম লাইনআপে পরিবর্তন আসে। তখন বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয় ‘শহরতলী’কে, তখন পারফর্মিং ভোকাল হিসেবে ব্যান্ডে যোগ দেন জিল্লুর রহমান সোহাগ।

ব্যান্ডের বর্তমান লাইনআপমিশু খান (ভোকাল, রিদম গিটার), জিল্লুর রহমান সোহাগ (পারফর্মিং ভোকাল), সাদি মোহাম্মাদ (কি-বোর্ড), ফাহিম পাশা (লিড গিটার), মাহবুবুল আকরাম রবি (ড্রামস), ওয়াসিফ আহমেদ (বেজ গিটার) এবং মাহিবুল হাসান মাহিম (সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার)।

সব প্রথম
২০০৫ সালে প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্ম করে ‘শহরতলী’। নিজেদের মৌলিক কিছু গানের সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরী ও জেমসের কিছু গান কভার করে। সে সময়ের স্মৃতিচারণায় ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ভোকাল মিশু বলেন, ‘সেদিন নিজেদের কিছু গানের সঙ্গে জেমস, বাচ্চু ভাই (আইয়ুব বাচ্চু) আর মহীনের ঘোড়াগুলির গান করেছিলাম। বিশেষ করে বলতে গেলে, সঞ্জীব চৌধুরীর গানও করেছিলাম। আসলে ওনার দ্বারা আমরা অনেকটা প্রভাবিত।’

কনসার্টে শহরতলী। ছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

২০০৭ সালে জি-সিরিজের ব্যানারে প্রকাশ পায় মিক্সড অ্যালবাম ‘নিয়ন আলোয় স্বাগতম’। সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা পাওয়া এ অ্যালবামে প্রকাশ পায় ব্যান্ডটির প্রথম গান ‘আসাদের খোলা চিঠি’। প্রয়াত কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা থেকে তৈরি হয় ‘আসাদের খোলা চিঠি’ গানটি। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘প্রথমে আমরা গান নিয়েই কাজ করতাম। পাশাপাশি কবিতা নিয়েও চর্চা ছিল। সবাই মিলে চিন্তা করছিলাম, কবিতার সঙ্গে গানের কীভাবে মেলবন্ধন ঘটানো যায়। তো আসাদ চৌধুরীর এই “বারবারা বিডলার” কবিতা থেকেই আমরা প্রথম কাজ করতে শুরু করি। ২০০৫-০৬ সালের দিকে গানটি রেকর্ড হয়। কবিতাটি হুবহু রেখে গানটিতে সমসাময়িক কিছু কথা নিজেদের মতো উপস্থাপন করি। লিরিক ও কবিতার সংমিশ্রণ করে একটি ডেমো ভার্সন তৈরি করি। পরে সেটি আসাদ চৌধুরী স্যারের কাছে নিয়ে যাই। তাঁর বাসায় ওই ডেমো নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে খুব ভয়ে ছিলাম, তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করছি, বিষয়টি তিনি কীভাবে নেবেন? কিন্তু কবিতাটি নিয়ে আমরা কাজ করছি, এটা শুনে খুব খুশি হন তিনি। যখন তাঁকে গানটা শোনাই, পুরো গানটি হেডফোনে শোনার পর তাঁর চোখে পানি চলে আসে। জানালেন, এটা নিয়ে যে আমরা কাজ করতে পারি, সেটা তিনি ভাবতে পারেননি!,’ বললেন মিশু।

‘সত্যি কথা বলতে, ওই গানের পর থেকেই আমরা একধরনের সাহস পাই কবিতা নিয়ে কাজ করার। যেহেতু এত গুণী একজন মানুষ তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করার ফলে খুশি হয়েছেন, তাই আমাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায়—এ ধরনের গান করা যেতে পারে। আসলে থিয়েট্রিক্যাল রক নিয়ে কিছু করা যায়, সেটা তখনই মাথায় আসে,’ যোগ করেন মিশু।

ব্যান্ডের সব সদস্য স্বাবলম্বী। ফলে কাউকে মিউজিক করে সংসার চালাতে হয় না

‘আসাদের খোলা চিঠি’র পর থেকেই কবিতা নিয়ে কাজ করার সাহস পায় ‘শহরতলী’। আসাদ চৌধুরীর মতো গুণী একজন মানুষের কবিতা নিয়ে কাজ করে তাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মায়—এ ধরনের গান করা যেতে পারে। থিয়েট্রিক্যাল রক নিয়ে আগানো যায়, সেটা তখনই তাদের মাথায় আসে। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকাশ পায় ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম ‘বরাবর শহরতলী’। ‘জেলখানার চিঠি’, ‘প্রস্থান’, ‘প্রতিক্রিয়া’, ‘অতলে শহরতলী’সহ ১০টি গান ছিল অ্যালবামটিতে। নাজিম হিকমতের কবিতা থেকে ‘জেলখানার চিঠি’ ও শামসুর রাহমানের ‘যদি তুমি ফিরে না আসো’ থেকে তৈরি হয় গান ‘প্রস্থান’। দুটি গানই ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। এরপর ২০১৩ সালে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য’। এ অ্যালবামের ‘নীলিকা’, ‘গণজোয়ার’, ‘দেশমাতার কাছে চিঠি’ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

গানে গানে প্রতিবাদ
রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদে সব সময় সরব ছিল ‘শহরতলী’। তাদের ভাষ্যে ,‘‘‘শহরতলী’’ ব্যান্ডের সব সদস্য স্বাবলম্বী। ফলে কাউকে মিউজিক করে সংসার চালাতে হয় না। তাই যেকোনো সংকটে আমরা প্রতিবাদে সম্মুখে থেকেছি।’ ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হয় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ কলনিটারী গ্রামের ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী। ফেলানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে গানে গানে প্রতিবাদ জানায় ‘শহরতলী’। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতার মিশেলে লেখা হয় গান ‘ফেলানী’।

‘কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছে কিশোরীর লাশ!/ ধর্ষিত পতাকায় আমার অক্ষম বর্ধিত দীর্ঘশ্বাস’ গানটি প্রকাশ পায় ২০১২ সালের ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘হাতিয়ার’-এ। ফেলানী হত্যার বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সমাবেশ ও মানববন্ধনে বাজতে থাকে এই গান। তবে সে সময় গানটির জন্য বেশ ঝামেলায় পড়ে ‘শহরতলী’। মিশুর তথ্যে, ‘সে সময় বিটিভির একটা রেকর্ডিংয়ে যখন আমরা গানগুলো করছিলাম, প্রোডিউসার তখন ‘‘ফেলানী’’ ও ‘‘দেশমাতার কাছে চিঠি’’ গানগুলো না করার জন্য অনুরোধ জানান আমাদের। ব্যক্তিগতভাবে গান দুটি তিনি পছন্দ করলেও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এর প্রচার তিনি করতে পারবেন না বলেও জানান।’ সবশেষ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানেও ব্যান্ডটির অবস্থান ছিল রাজপথে।

রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদে সব সময় সরব ছিল ‘শহরতলী’

নতুন গান নিয়ে
‘এখন, এখানে…’ শহরতলীর তৃতীয় অ্যালবাম, যার পাঁচটি গান গত কয়েক বছরে ব্যান্ডটি তাদের অফিশিয়াল ইউটিউব, স্পটিফাই ও অন্যান্য মাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছে। অ্যালবামটিতে আরও জায়গা পাবে তিনটি গান। ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অ্যালবামের বাকি ৩টি গান রিলিজ করবে ‘শহরতলী’। এরই মধ্যে আগামী শুক্রবার ২২ নভেম্বর মুক্তি পাবে প্রথম গান ‘আরেকটি প্রহর’। মানুষের অনিশ্চিত যাত্রা নিয়েই গানটি তৈরি করেছে ‘শহরতলী’। ২০২২ সালে ঢাকায় নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের ক্রেন থেকে কংক্রিটের গার্ডার খসে পড়ে মারা যায় নবদম্পতি। এ ঘটনা বেশ কষ্ট দেয় ‘শহরতলী’কে।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক বেশ কিছু দুর্ঘটনার মধ্যে বেইলি রোডের আগুন প্রভাবিত করে তাদের। তাদের মতে, ‘এ যে একটা অনিশ্চিত যাত্রা আমাদের, প্রতিদিন বের হওয়ার পর জানি না ঘরে ফিরতে পারব কি না। ‘‘আরেকটি প্রহর’’ গানের থিমেটিক জায়গা এটিই। শুধু অডিও নয়, এর সঙ্গে একটি ভিজ্যুয়ালও আসবে। তবে তা বর্তমান সময়ের তথাকথিত মিউজিক ভিডিও ঘরানার নয়।’ অ্যালবামটির বাকি গানগুলো নিয়ে ব্যান্ডের পারফর্মিং ভোকাল সোহাগ বলেন, ‘যেহেতু আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের গান করি, ফলে আমাদের প্রতিটা গানের পেছনে একটু বেশি সময় দিতে হয়। আসছে “আরেকটি প্রহর” গানটি। এবারও আমরা চেষ্টা করেছি স্বতন্ত্র ছন্দে আর স্বকীয়তা বজায় রেখেই শ্রোতাদের কাছে নতুন কিছু নিয়ে আসতে।’

‘শহরতলী’ সদস্যরা। ব্যান্ডের সৌজন্যে

ব্যান্ডটির ড্রামার ও গানটির গীতিকার রবি বললেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত অজানার হাতে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি বা দিতে বাধ্য হচ্ছি! আসলে এমন অসহায়ত্ব নিয়েই গানটি লেখা। শহরতলী বরাবরই চেষ্টা করে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতা, মানবাধিকার, সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু, ভাষা ও মুক্তির চেতনা—এসব কিছুকে প্রতিবাদী কণ্ঠে তুলে ধরার।’