‘লিলুয়া বাতাস’, ‘জীবন নদীর ঘাটে বসে’, ‘এমন যদি হতো’ থেকে ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’— এমন কত গানই না কনক আদিত্যর কণ্ঠে শুনেছেন শ্রোতারা। কিছুদিন ধরে শুনছেন ‘পারাপার’ শিরোনামে নতুন একটি গান। গানটি শ্রোতাদের কাছে তাঁকে যেমন নতুনভাবে তুলে ধরছে, তাঁর নিজের জন্যও এই গান গাওয়াটা নতুন অভিজ্ঞতা। কনকের গাওয়া এ গান তৈরি করেছেন শিরোনামহীন ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জিয়াউর রহমান। নিজের ব্যান্ডের বাইরে এবারই প্রথম তিনি কারও জন্য কোনো গান করলেন।
কনক আদিত্য ও জিয়াউর রহমান দুজনই এখন দেশের বাইরে আছেন। জিয়া আছেন কাশ্মীরে আর কনক অস্ট্রেলিয়ায়। ‘পারাপার’ নিয়ে অনলাইনে দুজনের সঙ্গে কথা হয় গত বুধবার। জিয়াউর রহমান জানালেন, ‘আমার মিউজিক্যাল জার্নিতে শিরোনামহীনের বাইরে কখনোই গান করিনি। কেউ খেয়াল করেছেন কি না জানি না, আমি শিরোনামহীনের জন্য এক্সক্লুসিভ রেখেছি নিজের সুর ও লেখা। যৌথ প্রয়াস হয়েছে, বাজিয়ে দিয়েছি, প্রোডাকশন করে দিয়েছি, মিক্স/মাস্টার করেছি, নানা সহযোগিতা করেছি...কিন্তু নিজের সৃষ্টি ব্যান্ডের বাইরে থেকে প্রকাশ করিনি। এবার করেছি। আমার বন্ধুর জন্য।’
কনক আদিত্য জলের গান ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বন্ধু রাহুল আনন্দের ওপর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ব্যান্ডটি থেকে বেশ কয়েক বছর আগেই ছুটি নিয়েছেন তিনি। মূলত সেই ‘দলছুট’ বন্ধু কনকের জন্যই এবার দলের বাইরে গিয়ে কোনো গান করলেন জিয়াউর রহমান, ‘অনেক আগে বন্ধু কনক আদিত্যকে কথা দিয়েছিলাম একটা গান করে দেব। এটা তারই বাস্তবায়ন বলতে পারেন।’
কনক জানালেন, পারাপার তাঁদের এক বছরের প্রয়াস। কনক বললেন, ‘সাধারণত যেসব গান আমি গেয়ে থাকি, সেটার একটা ধরন আছে। জিয়ারও একটা আলাদা স্টাইল আছে। তবে জিয়া যখন কারও জন্য গান বানায়, আদ্যোপান্ত জেনেবুঝে তারপর বানায়। তারপর ওর একটা সিগনেচারও রাখে। গলার স্কেল বুঝে বানায়। এই গানের পেছনে আমাকেও অনেক সময় দিতে হয়েছে। এযাবৎকালে যে ধরনের গান করেছি, এটা তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন। বলা যায়, সাধারণ চরিত্রের বাইরে। জিয়াও বোঝে, কাকে দিয়ে কী হবে।’
১৯৯৬ সালের দিকে জিয়াউর রহমান ও কনক আদিত্যর পরিচয়। তখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী। পরে জিয়াউর রহমান ভর্তি হন বুয়েটে আর কনক আদিত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়। কমন ফ্রেন্ড শাওনের মাধ্যমে পরিচয়। একটা সময় চারুকলায় পড়াশোনা শেষ করে মিরপুরের রূপনগরে বাস করা শুরু করেন কনক। জিয়াউরও ওখানেই থাকতেন। মিরপুর থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে।
বন্ধু কনক আদিত্যকে নিয়ে জিয়ার আক্ষেপের শেষ নেই, ‘আমার এই অসাধারণ কণ্ঠের বন্ধুটির ওপর আমি রীতিমতো ক্রুদ্ধ! ওর কণ্ঠে প্রকাশিত গানের সংখ্যা এত কম থাকবে কেন? আমি মনে করি, দেড়–দুই শ গান প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। এ রকম সুন্দর কণ্ঠ সবার থাকে না।’
‘পারাপার’ নিয়ে জিয়া বলেন, ‘ভয়ানক নিঃসঙ্গ অনুভূতির গান। নিজের ভেতরে হাহাকার আর আর্তচিৎকারের গান। সব কথা সবাই বলতে পারে না। ভেতরেই থেকে যায়। বেদনার অনুভূতি নীল থেকে গভীর নীল হয়। হৃদয়ে বেঁচে থাকে অসহায় বনসাই। এটি মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউয়ের গান নয়। একজন শুনলেও সে যদি নিজে থেকে দ্বিতীয়বার গানটি শোনার আগ্রহ প্রকাশ করে; সেখানেই আমার সার্থকতা।’
যাঁর কণ্ঠে গানটি শ্রোতারা শুনছেন, সেই কনক আদিত্য বলছেন, ‘“পারাপার” অনেক বেশি কাব্যময়। আমি বা জলের গান যেসব গান করেছি, একটু সহজ ছিল, সবার মধ্যে ঢুকতে পারি, জিয়ার ব্যাপারটা আলাদা। ওর মধ্যে কাব্যিক ব্যাপারটা বেশি। এটা আমার জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা। যেহেতু জিয়ার গানের সঙ্গে অনেকে পরিচিত, সে ক্ষেত্রে ঝামেলা হওয়ার কথা না। আমার যারা গান শোনে, তারা নতুন একটা স্বাদ পাবে। আমার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিংও মনে হয়েছে। অহরহ এমন গাওয়া আমার জন্য কঠিন। যারা রক গান গেয়ে থাকে, রক ভোকাল, তাদের জন্য হয়তোবা সহজ।’
‘পারাপার’ তৈরিতে তো এক বছর লেগে গেল। দুজনকে আবার একসঙ্গে নতুন কোনো গানে দেখা যাবে কী—এমন প্রশ্নে কনকের বক্তব্য, ‘আবার কবে ওর (জিয়াউর রহমান) মর্জি হবে। আমার সময় হবে। এখনই বলা মুশকিল।’