গাওয়ার কথা ছিল ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। কিন্তু গেয়েছেন প্রায় তিন ঘণ্টা। পরিবেশনার মাঝে মাঝে মিটিয়েছেন দর্শক–শ্রোতার নানা আবদার। নির্ধারিত পরিবেশনা শেষে মঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েও শ্রোতাদের অনুরোধে আবার ফিরে এসেছেন, গেয়েছেন আরও ৪০ মিনিট। সব মিলিয়ে পাকিস্তানি গায়ক আতিফ আসলামের দিক থেকে চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এরপরও গত শুক্রবার আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত ‘ম্যাজিক্যাল নাইট ২.০’ কনসার্টটি দর্শক ও আশপাশের মানুষের কাছে চরম বিরক্তি আর ভোগান্তির উদাহরণ হয়ে রইল। টিকিট কেটেও দর্শকের ভেন্যুতে প্রবেশ করতে না পারা, ভেন্যুর ফটকে হয়রানি, ধারণক্ষমতার বেশি দর্শক ঢোকানো, আতিফ আসলাম মঞ্চে ওঠার পর বৈদ্যুতিক গোলযোগ, কনসার্টকে কেন্দ্র করে উত্তরা থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়কে তীব্র ট্রাফিক জ্যাম—নানা অভিযোগ।
আয়োজকেরা জানিয়েছিল, বেশ কয়েক দিন আগেই কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। সঙ্গে এ-ও জানিয়েছিল, ধারণক্ষমতার চেয়ে কম টিকিট বিক্রি করছে তারা। তবে সরেজমিনে কনসার্ট ভেন্যুতে গিয়ে তাদের কথার সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি দর্শককে কনসার্টে দেখা গেছে।
দর্শক-শ্রোতার দীর্ঘ লাইন আর্মি স্টেডিয়াম থেকে কাকলী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। উত্তরা থেকে মহাখালী পর্যন্ত পুরো সড়ক স্থবির হয়ে যায়। ট্রাফিক গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার আবু সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তার পরিস্থিতি ঠিক হতে রাত প্রায় তিনটা বেজে যায়। দর্শকদের একাধিক লাইনের সঙ্গে টিকিট ছাড়া মানুষের কনসার্টে ঢোকার চেষ্টায় পুরো রাস্তা স্থবির হয়ে যায়। পার্কিং–ব্যবস্থা না থাকায় স্টেডিয়ামের সামনে বিশাল জটলা তৈরি হয়। আয়োজকদের এসব বিষয়ে ভাবার দরকার ছিল। লাইনগুলো ঠিক রাখলে এ অবস্থা হতো না।’ আবার কনসার্ট উপভোগ করতে যাঁরা টিকিট সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের অভিযোগও আয়োজকদের বিরুদ্ধে উঠেছে।
আতিফ আসলাম যখন মঞ্চে ওঠেন, তখন রাত পৌনে নয়টা। ওঠার পরপরই লোডশেডিংয়ের কারণে ধাক্কা খান তিনি। ২০ মিনিট বিরতির পর গাওয়া শুরু করেন, একটানা গাইলেন তিন ঘণ্টা। ম্যাজিক্যাল জোন, ফ্রন্ট জোন ও জেনারেল—এই তিন ক্যাটাগরিতে বিক্রি হয়েছে কনসার্টের টিকিট।
ম্যাজিক্যাল জোনের টিকিটের মূল্য রাখা হয় ১০ হাজার টাকা। আতিফ আসলামকে কাছ থেকে দেখতে মিরপুর-১১ নম্বর থেকে পরিবারসহ কনসার্টে আসেন রবিন মাহমুদ। পরিবারের চার সদস্যের জন্য তিনি খরচ করেছেন ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু মঞ্চের সামনে নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবক ও দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকের কারণে কিছুই দেখতে পারেননি তিনি। কনসার্টের দিন রাত সাড়ে ১০টায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘টিকিট বিক্রি পর্যন্ত আয়োজকদের পাওয়া যায়। এরপর তারা লাপাত্তা। পরিবার নিয়ে গেটে হয়রানির শিকার হয়েছি।
এত টাকা খরচ করেও কিছুই দেখতে পারছি না। এ আয়োজন নিয়ে চরম বিরক্ত আমরা। দেশ-বিদেশে অনেক আয়োজন দেখেছি, কিন্তু এখানে যা হলো, তা স্রেফ প্রতারণা।’
টিকিট সংগ্রহ করেও এদিন কনসার্টে ঢুকতে পারেননি দুই শতাধিক দর্শক। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে বিষয়টি নিয়ে দর্শকেরা প্রশ্ন করলে তাঁরা জানান, আয়োজক পক্ষ থেকে নির্দেশনা পেয়েই গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কনসার্টে ঢুকতে না পেরে ফিরে গেছেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘জীবনের সব ধরনের অভিজ্ঞতা দরকার, আজকে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমাকে রিসিভ করার জন্য ভেতরে লোকজন ছিল, কিন্তু দায়িত্বরত ব্যক্তিদের তা জানানো সত্ত্বেও তাঁরা আমাকে কনসার্টে ঢুকতে দেননি। এখন আমি জানি না তাঁদের প্রশংসা করব না নিরাপত্তা নিয়ে দুঃখবোধ করব।’ কনসার্টের অব্যবস্থাপনা নিয়ে ফেসবুকে আয়োজকদের প্রতি ক্ষোভ ঝাড়েন চিত্রনায়িকা প্রার্থনা ফারদীন দীঘি। তবে কিছুক্ষণ পরই তাঁর ফেসবুক পোস্টটি সরিয়ে নেন তিনি।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান ট্রিপল টাইম কমিউনিকেশনের আরিফা শবনম প্রথম আলোকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় জানালেন, ‘এত বড় আয়োজনে কিছু ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে, তার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা ইতিমধ্যেই ত্রুটিগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছি, যাতে ভবিষ্যতে আরও দারুণ এবং স্মরণীয় কনসার্ট দর্শকদের উপহার দিতে পারি।’
যা গাইলেন ও বললেন আতিফ
বিকেল পাঁচটায় কাকতাল ব্যান্ডের গান দিয়ে শুরু হয় মূল কনসার্ট। ব্যান্ডটি ‘গোলকধাঁধা’, ‘আবার দেখা হবে’, ‘সোডিয়াম’, ‘ওপেন সিক্রেট’সহ একাধিক গান করে। এর পর মঞ্চে ওঠেন পাকিস্তানের তরুণ সংগীতশিল্পী আবদুল হান্নান। ‘ইরাদে’ গান দিয়ে শেষ হয় তাঁর ঘণ্টাখানেকের পরিবেশনা। পরিবেশনা শেষে দর্শকের উদ্দেশে আপ্লুত হান্নান বলেন, ‘জীবনে এই প্রথম এত দর্শকের সামনে গাইলাম। সুন্দর মুহূর্ত কাটানোর জন্য বাংলাদেশের দর্শকদের প্রতি অনেক ভালোবাসা।’
হান্নানের পরিবেশনা শেষে রাত আটটার দিকে স্টেজে ওঠেন তাহসান খান। ৩০ মিনিটের পরিবেশনায় একে একে গেয়ে শোনান ‘প্রেম তুমি’, দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘প্রেমাতাল’, ‘আলো’সহ কয়েকটি গান। আতিফ আসলাম মঞ্চে ওঠার আগে জুলাই ‘বিপ্লব’ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের ভিডিও চিত্র ‘জুলাই অনির্বাণ’ দেখানো হয়। এরপরই মঞ্চে আসেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। জুলাই বিপ্লবের শহীদদের স্মরণে কথা বলেন তিনি।
‘ম্যাজিক্যাল নাইট ২.০’ কনসার্টে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন পাকিস্তানের আতিফ আসলাম।
চলতি বছর দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় এসেছেন আতিফ আসলাম। গানের পাশাপাশি ভক্ত-শ্রোতাদের আবদার মেটান তিনি। মঞ্চের সামনের দর্শকের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড, ছবি ও টি-শার্টে স্বাক্ষর দিয়েছেন পাকিস্তানি এই শিল্পী।
গানের সময় ভক্তদের গলা মেলাতে মাইক্রোফোন এগিয়েও দেন তিনি। গানের মাঝে গিটার বাজিয়ে মাতিয়ে রাখেন। রাত ১১টায় মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু শ্রোতাদের আবদারে আবার মঞ্চে আসেন। গাইলেন আরও ৪০ মিনিট।
এদিন আতিফ একে একে গেয়েছেন ‘তেরা হুনে লাগা’, ‘ম্যায় তেনু সামজাওয়ান কি’, ‘ও রে প্রিয়া’, ‘মেরে পিয়া ঘর আয়া’, ‘এক প্যায়ার কা নাগমা হে’, ‘পেহলি নাজর মে’, ‘কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’, ‘ওহ লামহে’, ‘তেরে লিয়ে’, ‘পেহেলি দাফা হে’, ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’, ‘গুলাবি আঁখে’, ‘তেরে বিন’, ‘তু জানে না’, ‘কুন ফায়া কুন ফায়া’, ‘ম্যায় রং শারবতো কা’, ‘তেরে সাং ইয়ারা’সহ শ্রোতৃপ্রিয় আরও কিছু গান।
এদিন দর্শকদের উদ্দেশে আতিফ বলেন, ‘বাংলাদেশ সব সময় আমার সেকেন্ড হোম, এখানকার দর্শকের ভালোবাসা নেওয়ার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’