মঞ্চই তাঁর ঘরবাড়ির মতো ছিল। স্টুডিও ছিল সবচেয়ে প্রশান্তির জায়গা। মঞ্চে গান গাইতে আজ ঢাকায় তো কাল চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী। আবার কখনো আমেরিকা–ইউরোপের কোনো দেশ—এভাবেই চলছিল দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিতের জীবন। চার দশকের সংগীতজীবনে রুটিনটা ছিল এ রকমই। এক দুর্ঘটনায় ১৪ মাস আগে হঠাৎ সব ওলটপালট হয়ে যায়।
একমাত্র সন্তান কুমার নিবিড়ের দুর্ঘটনায় কুমার বিশ্বজিতের কোনো কিছুই আর পরিকল্পনার মধ্যে নেই। মঞ্চের কোনো আয়োজনে দেখা যায়নি তাঁকে। হাসপাতালে জীবন–মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকা একমাত্র সন্তানের পাশে থাকতে ১৪ মাস ধরে স্ত্রীসহ কানাডায় এখন তাঁর ঘরবাড়ি। গত ১৮ এপ্রিল কয়েক সপ্তাহের জন্য ঢাকায় এসেছেন তিনি। এবার এসে তাঁর মঞ্চের বিরতি ভেঙেছে। ঢাকার একটি মঞ্চে গাইলেন তিনি। এত দিন পর শ্রোতারা তাঁকে পেয়ে উদ্যাপনে মেতে ওঠেন।
ছেলের অসুস্থতার খবর শুনে কানাডায় ছোটার আগে কুমার বিশ্বজিৎ স্টেজ শো নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। সারা দেশের স্টেজ শোতে তাঁর চাহিদাও সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে বেশি। এদিকে এপ্রিলের আগেও একবার যখন কানাডা থেকে কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ, তাঁকে মঞ্চে গান গাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়; কিন্তু মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে না পারায় মঞ্চে ফেরেননি। এবারও আসার খবর শুনে একাধিক আয়োজক প্রতিষ্ঠান কুমার বিশ্বজিতের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কয়েকটি অনুষ্ঠান না করতে পারলেও গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের আয়োজন কোনোভাবেই না করতে পারেননি।
দীর্ঘ বিরতির পর স্টেজ শোতে ফিরলেও মন খুবই বিষণ্ন ছিল কুমার বিশ্বজিতের। স্টেজ শো শেষে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় কুমার বিশ্বজিতের। তিনি বলেন, ‘নিজের মন নিয়ন্ত্রণ করে কোনোভাবে এই শো করা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ভালো থাকার বৃথা চেষ্টা। নিবিড়ের দুর্ঘটনার পর আমার কাছে এখন পুরো পৃথিবী বিবর্ণ মনে হয়। বিবর্ণ এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। তাই দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা শো ক্যানসেল করেছি। মনে থেকে কোনোভাবে সায় দিচ্ছিল না। আমার কাছে এখন শিল্পীর চেয়ে বাবার অস্তিত্বটা বারবার ভেসে ওঠে। আমি যখন মঞ্চে গাইছিলাম, অবচেতন মনে নিবিড়ের মুখটা ভেসে উঠছিল। স্টেজে থাকলে অনেক সময় সবকিছু ভুলে যেতে হয়। কিন্তু বাবা–সন্তানের অস্তিত্বটা এক প্রগাঢ় যে প্রতি পদে পদে অনুভব করেছি।’
এদিকে কুমার বিশ্বজিতের মঞ্চে ফেরার খবরে বিনোদন অঙ্গনের অনেকে বেশ খুশি। তাঁদের মতে, চিরচেনা জগতে যদি তিনি ব্যস্ত থাকেন, তাহলে কিছুটা হলেও কষ্ট ভুলে থাকতে পারবেন। তবে বিশ্বজিৎ মনে করছেন, এটা কোনোভাবেই ভুলে থাকা সম্ভব নয়। তাঁর কাছে সবকিছু বিবর্ণ মনে হয়; ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা। পিতার অস্তিত্বটা এত বেশি যে তা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
কয়েক বছর আগের কথা। বেশ চলছিল সবকিছু। ছেলে কানাডার একটি কলেজে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে পড়াশোনায় ব্যস্ত। বাবা উত্তরার বাড়িতে বসে একদিন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অনেক স্বপ্ন ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন। কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছিল তাঁর। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবাও দেশ–বিদেশে গানে গানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। শ্রোতাদের মাতিয়ে চলছিলেন।
হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা যেন মুহূর্তেই সব হিসাব–নিকাশ পাল্টে দেয়। কানাডায় ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় ছেলে কুমার নিবিড় মারাত্মকভাবে আহত হন। এর পর থেকে বাবা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হন কুমার বিশ্বজিৎ। ১৪ মাস ধরে এমন অবস্থা চলছে। সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার প্রহর গুনছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাবা কুমার বিশ্বজিৎ। আশায় বুক বেঁধেছেন বাবা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা নিবিড়কে এখন চেয়ারে বসানো যাচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে মা–বাবাকে দেখছেনও।
১৪ মাস ধরে কুমার বিশ্বজিৎ অবস্থান করছেন কানাডার টরন্টোয়। সেখানে সেন্ট মাইকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাঁর একমাত্র সন্তান কুমার নিবিড়। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন নিবিড়। তার পর থেকেই মা–বাবা দুজনের ঠিকানা সেই সেন্ট মাইকেল হাসপাতাল। দীর্ঘ ১৪ মাস কুমার বিশ্বজিৎ ছিলেন সুরের বাইরে।
ছেলের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমার বিশ্বজিৎ বললেন, ‘শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে। কিন্তু কবে যে পুরোপুরি সুস্থ হবে, তা বলা মুশকিল। এখনো হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।'