গুণী সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী। তাঁর বাবা মাহমুদুন্নবী গত শতকের ৬০ থেকে ৮০-এর দশকে বাংলা গানের জগতে ছিলেন উজ্জ্বল। নিয়মিতভাবে মনের মতো কথা ও সুরের গান প্রকাশ করে চলছেন। এর মধ্যে নিজের উপলব্ধি থেকে ফাহমিদা নবী জানালেন, রুচিহীন গান বেশি দিন ধোপে টেকে না। ছোটবেলা থেকেই এমনটা দেখে আসছেন বলে জানালেন তিনি।
২১ জুন ছিল বিশ্বসংগীত দিবস। মন খারাপ করা ফেসবুক পোস্টে ফাহমিদা নবী জানালেন, তবে কি সংগীত দিবস ব্যর্থ, আমাদের অস্থির মানসিকতার করাঘাতে? ফেসবুকে ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ‘ভাবলাম বর্তমানে অনেক সিনেমা তৈরি হচ্ছে, কিছু সো কল্ড ভিউ গানের পাশাপাশি, শোনার মতো গানও তৈরি হবে বোধ হয়। তা আসলে হওয়ার নয়। রুচিহীনতা একটি বিশাল কারণ, ভালো গান না তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে।’
ভালো গান তৈরির জন্য কী দরকার, তা-ও ফাহমিদা নবী তাঁর লেখায় প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভালো গানের জন্য অস্থিরতার দৌড় নয়, ভালোবাসা দরকার, সেটাই তো নাই! তবে বলে রাখি, রুচিহীন গান বেশি দিন ধোপে টেকে না, দেখছি সেই ছোটবেলা থেকে। শ্রোতারাও এত গাধা নয়। যারা গান শোনে, তারা ভালো মেলোডিয়াস গানই খোঁজে, মনেও রাখে। শ্রোতাকে দোষী করে কোনো লাভ হবে না। যারা মেধার অপচয় করছে, তারাই বড় বিপদে পড়বে।’
আগে ভালো গান তৈরির একটা প্রতিযোগিতা ছিল। এখন সেটা অনেকটাই কমে গেছে, মনে করছেন ফাহমিদা নবী।
তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রুচির হাহাকারে, প্রতিযোগিতাটা মারপিট সিনেমার দৃশ্যের মতো হয়ে গেছে, কিন্তু সত্যিকার প্রতিযোগিতায় মেধার অ্যাকশন দরকার, সেটাই এখন নাই! কেউ সহজ করে হাসে না, প্রয়োজনে হাসে বলেই এই দুর্ভিক্ষ! আত্মবিশ্বাস আর অভিমান, সংগীতের ক্ষেত্রকে আরও বড় করে। বর্তমানে সমাজে তো কোনো সংস্কৃতিচর্চা, ভালোবাসা, সম্মান কিছুই নাই। আছে উন্মাদনা, অস্থিরতা আর কে কাকে পেছনে ফেলে দৌড় দেবে, সেই স্বার্থপর চিন্তা! কোনো সরল হাসি নাই। করপোরেট সিন্ডিকেট চর্চা যেখানে প্রবল, সেখানে আর যা-ই হোক, সংগীত হবে না। আর এখন তো আরও সম্ভব নয়! সংগীতের ধারা শান্ত ও রাজকীয়, তা সাজানোর জন্য ধীরতা দরকার। যাহা মনে লয় উন্মাদনা, ইন্ডাস্ট্রিকে দিন দিন অশিক্ষিত করে তুলেছে।’
ফেসবুক পোস্টের একপর্যায়ে ফাহমিদা নবী লিখেছেন, ‘শ্রোতা-দর্শককে কী দেব, কী দেব না—সেই জ্ঞান সীমিত। সীমিত জ্ঞানে সংগীত যে একটি জ্ঞান, তা ধারণ করার ক্ষমতাই তো নাই। কীভাবে শ্রোতা-দর্শককে ভালো কিছু দেব? কে দেবে? কী দেবে? কী দেওয়া উচিত? সেটাও তো ব্যর্থ খাতার তালিকায় চকচক করছে! উটকো কথা আর সুরের চটপটিতে গান এখন পালিয়ে বাঁচতে চায়!’
দীর্ঘ সংগীতজীবনে এসে ফাহমিদা নবীর একটা বিষয় উপলব্ধিও হয়েছে, তা ফেসবুকে লেখার একেবারে শেষ দিকে উল্লেখ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘সংগীত সবার জন্য নয়, ইদানীং বিষয়টা আরও বুঝতে পারছি। সাধনা চলতে থাকুক—যারা সংগীতের সঠিক মানুষ বা শিল্পী, এই দৌড় তাদের জন্য নয়। তারা দৌড়ায় না, অস্থিরও হয় না। একটা দেশের রুচিশীলতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? রুচির দুর্ভিক্ষে সত্যিই আমরা তলিয়ে গেছি, আফসোস! কিছু মানুষ হয়তো এখনো পরিশোধিত ফিল্টারে নিজেকে নীরব সাধনায় রাখছে। তারাই আশা। আশা ছাড়া অভিমান কি বাঁচে? অভিমান জরুরি, তা না হলে জ্ঞান আর অশিক্ষার মধ্যে পার্থক্য বোঝা যাবে কী করে? ফেসবুকের দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়া উদ্দেশ্যটা একদম তোমাকেই পরাজিত করছে। ধীরে বুঝবে, তখন আর সময়টা সময় দেবে না। আবারও বলি শ্রোতা কিন্তু বোকা নয়…।’