কোক স্টুডিও বাংলায় প্রচারিত দুই নজরুলসংগীত ‘বুলবুলি’ ও ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সাড়াও ফেলেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে নজরুলকে ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের উদ্যোগ কতটা কার্যকর, খোঁজখবর করলেন মনজুর কাদের
কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম মৌসুমে ঋতুরাজ ও নন্দিতার কণ্ঠে শোনা যায় ‘বুলবুলি’। অর্ণবের সংগীতায়োজনে নজরুলের গানটি গত মঙ্গলবার পর্যন্ত (১৪ মাসে) ২ কোটি ১৫ লাখ ৯২ হাজার বারের বেশি ভিউ হয়েছে। অন্যদিকে মাসখানেক আগে মুক্তি পাওয়া নজরুলের ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ গানটি ৭৭ লাখ ৫২ হাজার বারের বেশি ভিউ হয়েছে। ঈশান ও নন্দিতার গাওয়া এই গানেরও সংগীতায়োজক অর্ণব।
‘বুলবুলি’ ও ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ গান দুটি সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের অনেকে আগে সেভাবে জানত না বলে মনে করছেন নজরুলসংগীতশিল্পী সুজিত মোস্তফা। তিনি বললেন, ‘উপস্থাপনের চমৎকারিত্ব, সুন্দর সংগীতায়োজন, ক্যামেরার কাজ ও পারফরম্যান্স—সব মিলিয়ে এই দুটি গান সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। এটাই তো অনেক বড় প্রাপ্তি। তবে কথা হচ্ছে, শোনার জন্য শোনা আর অনুপ্রাণিত হয়ে ওই গানের চর্চা করা আলাদা বিষয়। সমস্যা হচ্ছে গান গাওয়াটা কঠিন কাজ। নজরুলের গান আরও অনেক বেশি কঠিন। ফলে সেটা শোনার আনন্দে যে পরিমাণ মানুষ শুনেছে, শেখার আনন্দে খুব বেশি অনুপ্রাণিত হবে, তা নয়। কারণ, আমাদের এখানে সে রকম অবকাঠামো নেই, যেখানে এ ধরনের গান চর্চা করে আমাদের দেশে একজন শিল্পী জীবিকা নির্বাহ করতে পারে!’
নজরুলসংগীতের ভিন্ন রকম উপস্থাপন নিয়ে কয়েক বছর ধরেই কাজ করছেন দেশের কয়েকজন শিল্পী। তাঁদের মধ্যে তানভীর আলম সজীব যেমন আছেন, আছেন অর্ণবও। ভিন্ন সংগীতায়োজনে বিভিন্ন সময় নজরুলসংগীত শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন তাঁরা। এর বাইরে তরুণ প্রজন্মের আরও কয়েকজন শিল্পীকে দেখা গেছে, জন্মজয়ন্তী ও প্রয়াণদিবসে নজরুলসংগীতের আধুনিক উপস্থাপন করছেন।
নজরুলের গান তরুণদের দিয়ে গাওয়ান তানভীর আলম সজীব। তিনি নিরীক্ষাও করছেন। তিনি মনে করেন, ‘এখনকার তরুণেরা অনেক স্মার্ট। গানের ক্ষেত্রে তারা অনেক এক্সপেরিমেন্ট করছে। এক দশক আগেও এমন ছিল না। তবে যেভাবে নজরুলের গান নিয়ে তরুণেরা ভাবছে, সেভাবে এসব কাজ লালন করার মতো মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। বছরে দুই দিন নয়, সারা বছর তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’
কোক স্টুডিও বাংলায় প্রচারিত গান দুটি তরুণদের পাশাপাশি ভিন্ন বয়সীদের মধ্যেও যে প্রভাব ফেলছে, মন্তব্যের ঘরে ঢুঁ মারলে সেটা টের পাওয়া যায়। কেউ মুগ্ধ হয়ে লিখছেন, ‘অবাক বিস্ময় নিয়ে শুনেই গেলাম সারা দিন, দিনের পর দিন শুনেই গেলাম। বিস্ময় যেন কাটেই না। অসাধারণ গেয়েছেন দুজনই, হারমোনাইজে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও অসাধারণ। গোটা সেটে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই অসাধারণ। আর অসাধারণ আমাদের জাতীয় কবি।’ ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ প্রসঙ্গে শ্রাবণ নির্জয় নামের একজন ইউটিউবে মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘একসময় নজরুলগীতি গেয়ে স্কুলের প্রথম পুরস্কারটা নিয়েছিলাম। আজ গানটা শুনে সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেল।’
নজরুলসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী ফেরদৌস আরা তরুণদের মধ্যে নজরুলসংগীত তালিম দেওয়ার কাজটি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা শিক্ষকতা করি, তারা উপলব্ধি করতে পারি, তরুণদের মধ্যে নজরুল দারুণভাবে উদ্দীপনা জাগিয়ে রেখেছেন। এই চর্চা আরও বেশি দরকার। আরও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আমি মনে করি, সারা বিশ্বের যাঁরাই বাংলা চর্চা করে থাকেন, তাঁরা নজরুলের আদর্শ ও চেতনা নিয়ে ভাবেন। বিশ্বে তিনি এখনো আধুনিক।’
কোক স্টুডিওর মতো প্ল্যাটফর্ম কিংবা নানা সংকটের মধ্যে নিজস্ব উদ্যোগেও তরুণেরা নজরুলসংগীতের চর্চা করলেও এটিকে প্রসারিত করতে হলে সরকারকে সবচেয়ে আন্তরিক হতে হবে, মনে করেন সুজিত মোস্তফা। তিনি বললেন, ‘আমি আগেও বলেছি, সরকার যদি আইন করে দেয়, কোম্পানিগুলো টিভি চ্যানেলগুলোতে যা স্পনসর দেবে, তার একটা পার্সেন্টেজ—হোক তা ১০ বা ১৫ শতাংশ—যেন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ রাখে। সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে অবশ্যই সম্ভব।’