অরুণ চক্রবর্তী
অরুণ চক্রবর্তী

চলে গেলেন ‘লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা’ গানের স্রষ্টা অরুণ চক্রবর্তী

চলে গেলেন ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’র স্রষ্টা অরুণ চক্রবর্তী। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার চুঁচুড়ার ফার্ম সাইড রোডের বাড়িতে হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন পারিবারিক বন্ধু সপ্তর্ষি রায়বর্ধন।
প্রয়াত অরুণ চক্রবর্তীর মরদেহ বাড়ি থেকে চুঁচুড়া রবীন্দ্র ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুক্তমঞ্চে রাখা হয়। সেখানে গিয়েই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। পরে শ্যামবাবুর ঘাটে কবির শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। চুঁচুড়া ফার্ম সাইড রোডে অরুণের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিরা ছিল। জানা গেছে, এমনিতে সুস্থ ছিলেন অরুণ চক্রবর্তী। গতকাল কলকাতার মোহরকুঞ্জে জঙ্গলমহল অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। সেখান থেকেই কিছুটা ঠান্ডা লেগেছিল বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। কবির পুত্রবধূ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী জানিয়েছেন, করোনার পর থেকেই তাঁর ফুসফুসে সমস্যা ছিল।

প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, গানটি (প্রথম কবিতা হিসেবে লেখা) একটা গাছের চারা নিয়ে লেখা। ৫০ বছর আগে লেখা কবিতা, ১৯৭২ সালে। শ্রীরামপুরে।
চুঁচুড়া রবীন্দ্র ভবনে, আজ সকালে শেষ শ্রদ্ধা

১৯৪৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম কলকাতার বাগবাজারে। ১৯৯০ সাল থেকে চুঁচুড়ায় থাকতেন তিনি। পেশায় তিনি ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তবে একসময় সরকারি চাকুরে অরুণ কুমার চক্রবর্তী পুরোদস্তুর কবি। লিখতে, পড়তে ও বলতে ভালোবাসতেন তিনি। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করেছিলেন অরুণ। তাঁকে পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দিয়েছিল ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা, রাঙা মাটির দেশে যা’; ওই কবিতা পরে গান হয়ে দুই বাংলার সংগীতানুরাগীদের মুখে মুখে ফিরেছে। বাংলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতেন অরুণ। ঘুরতেন পাহাড়, জঙ্গল ও আদিবাসী এলাকায়। ‘লাল পাহাড়ের’ সুরেই অমর হয়ে থাকবেন কবি। জীবনকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, গানটি (প্রথম কবিতা হিসেবে লেখা) একটা গাছের চারা নিয়ে লেখা। ৫০ বছর আগে লেখা কবিতা, ১৯৭২ সালে। শ্রীরামপুরে। অরুণ কুমার আরও বলেছিলেন, ‘স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই মহুয়া ফুলের গন্ধ।

অরুণ কুমার চক্রবর্তী
বাংলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করতেন অরুণ। ঘুরতেন পাহাড়, জঙ্গল ও আদিবাসী এলাকায়। ‘লাল পাহাড়ের’ সুরেই অমর হয়ে থাকবেন।

দেখলাম ফুলভর্তি একটা মহুয়াগাছ। দৃশ্যটা আমাকে কেন জানি অবাক করেছে। মনে হলো, আচ্ছা গাছটি এখানে কেন? এ তো জঙ্গলে থাকার কথা। এটা হবে জঙ্গলের রানি। এখানে, এই রেলস্টেশনে তো একে মানাচ্ছে না। জঙ্গলমহলেই তাকে মানায়। আর সেখানে বসেই লিখে ফেললাম এই কবিতা। “হাই দ্যাখ গো/ তুই ইখানে কেনে/ ও তুই লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা/ রাঙা মাটির দ্যাশে যা হেথাকে তুকে মানাইছে নাইরে/ ইক্কেবারে মানাইছে নাইরে...।”’ তখন পর্যন্ত গানটির নাম ছিল ‘শ্রীরামপুর ইস্টিশনে মহুয়াগাছটা’। বাউলেরা অরুণ কুমার চক্রবর্তীকে গানটি বড় করার অনুরোধ জানালে তিনি ‘লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা’ নামে আবার লেখেন এবং নতুন করে সুর করেন।
অরুণ কুমার চক্রবর্তী সারা জীবনই বাউলের মতো চলাফেরা করেছেন। মাঝেমধ্যে বহিমিয়ানের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন। কর্মজীবনে প্রকৌশল বিভাগের উচ্চপদে চাকরি করা অরুণ চক্রবর্তীর চলাফেরা মূলত চিত্রশিল্পী, হকার, ফুল বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, বইয়ের দোকানদার, ফুচকাওয়ালাদের সঙ্গে। এমনটি নিজেই বলেছেন এই প্রতিবেদককে। তিনি বলছিলেন, ‘জানেন তো, আমি সারা জীবন তো বাইরে বাইরে কাটিয়েছি। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা, সোমনাথ থেকে কোহিমা। বাউলের মতো ঘুরে বেড়ানোতেই আমার আনন্দ।’ তবে মাঝেমধ্যে একদম নির্জনতা বেছে নেন। মেডিটেশন করতেন নিয়মিত। এ কারণে নির্জনতাকেই কিছুদিনের জন্য নির্ধারণ করে ফেলেন। ওই সময়টা কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না।

শীতে কলকাতায় আসতেন নিয়ম করে। বয়সে তুলনামূলক নবীনদের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব, আড্ডা। চলাফেরা সাদামাটা। পকেটে সব সময় চকলেট রাখতেন।
অরুণ কুমার চক্রবর্তী

তবে শীতে কলকাতায় আসতেন নিয়ম করে। বয়সে তুলনামূলক নবীনদের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব, আড্ডা। চলাফেরা একবারেই সাদামাটা। পকেটে সব সময় চকলেট রাখতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে হ্যান্ডশেক করে একটি চকলেট উপহার দিয়ে স্বাগত জানাতেন।
নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন অরুণ চক্রবর্তী। রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে লোকসংগীত; সাধারণ মানুষের কথা লিখতেন তিনি। সবচেয়ে বেশি লিখতেন প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে। ভারতের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।