র‍্যাপার হান্নান
র‍্যাপার হান্নান

থানা থেকে ছাড়াতে দেড় লাখ টাকা চেয়েছিল: র‍্যাপার হান্নান

বারুদের মতো র‍্যাপ গান ‘আওয়াজ উডা’ গেয়ে আলোচিত নারায়ণগঞ্জের তরুণ র‍্যাপার হান্নান হোসাইন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১২ দিন কারাগারে ছিলেন। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্তি মিলেছে তাঁর। আজ সোমবার দুপুরে হান্নানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মকফুল হোসেন

প্রশ্ন

‘আওয়াজ উডা’ আন্দোলনে অনেককে শক্তি জুগিয়েছে। গানটা কবে, কোন প্রেক্ষাপটে লিখলেন?

হান্নান হোসাইন: আন্দোলনে আমার ভাইবোনদের রাস্তায় মারা হচ্ছিল। আবু সাঈদের মতো অনেক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এসব দেখে চুপ করে থাকতে পারিনি। ১৭ জুলাই দুপুরে গানটা লিখতে বসেছিলাম, আড়াই ঘণ্টায় লেখা শেষ করেছি। রাতেই রেকর্ড করে পরদিন ১৮ জুলাই ইউটিউবে প্রকাশ করেছি।
গানটা যখন লিখেছি তখন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিলেন। পরে অল্প কিছু অভিভাবকও নেমেছেন। তবে অনেকে চুপ ছিলেন। কোনো কথা বলছিলেন না, নামছিলেনও না। আওয়াজও তুলতে পারছিলেন না। সেটা দেখেই গানের শিরোনাম করেছি, ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’।

প্রশ্ন

এই গানের কথা বারুদের মতো। ইনিয়ে–বিনিয়ে কিংবা মেটাফোরের আশ্রয় না নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন করেছেন, ‘রাস্তায় গুল্লি করল কেডা, আওয়াজ উডা বাংলাদেশ।’ গানকে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে নিলেন কেন?

হান্নান হোসাইন: তখন স্বৈরাচার সরকার মানুষকে মারছিল। সেই অবস্থা দেখে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে চুপ করে থাকা কঠিন ছিল। আমি একজন মিউজিশিয়ান। মিউজিকটাই পারি। ফলে মিউজিক করার চেষ্টা করেছি।
গান কোনো অপরাধ নয়। গান দিয়েই প্রতিবাদ করেছি। আমার কাছে প্রতিবাদ মানেই মিউজিক। প্রতিবাদের পর কী হবে না–হবে, সেটা ভাবিনি। গানটা প্রকাশের পরদিনই ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আমাকে হুমকি দেয়। ওরা বলেছিল, আমাকে বাসা থেকে তুলে নেবে। পরিবারের সদস্যদেরও ভয়ভীতি দেখিয়েছে। সেদিনই রাতে পুলিশ আমাকে খুঁজতে বাড়িতে এসেছিল। আমি বাড়িতে ছিলাম না; আত্মগোপনে ছিলাম।

প্রশ্ন

গানটা প্রকাশের এক সপ্তাহ পর ২৫ জুলাই আপনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোথা থেকে গ্রেপ্তার হলেন?

হান্নান হোসাইন: সেদিন দুপুরে এক আত্মীয়ের জানাজা থেকে রিকশায় চেপে বাড়িতে ফিরছিলাম। পথিমধ্যে ফতুল্লার ভুঁইগড় এলাকায় পুলিশ আমাকে আটকায়। পুলিশ ফোনটা নিয়ে অনুমতি ছাড়াই চেক করতে শুরু করে। ফোনে আমার গানটা ছিল, আন্দোলনে পুলিশের ধাওয়া, গুলির ভিডিও ছিল। একজন পুলিশ সদস্য বললেন, ‘ওরে পাইছি।’ বলেই আমাকে থানায় নেওয়া হয়। নেওয়ার পথে ওরা বলেছিল, জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেবে।

সেদিন দুপুরে আমাকে থানায় নেওয়া হয়; পরদিন দুপুর পর্যন্ত আমার পরিবারকে বিষয়টি জানানো হয়নি। পরে পরিবারকে জানানো হয়। পরিবারের কাছে প্রথমে এক লাখ টাকা চেয়ে পুলিশ বলেছে, মামলা দেবে না, ছেড়ে দেব। পরে একজন বলেছে, বড় স্যার ঝামেলা করছে। আরও ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। শেষে থানা থেকে ছাড়াতে দেড় লাখ টাকা চেয়েছিল। আমার পরিবার টাকা নিতে বাড়িতে গেছে, এদিকে আমাকে আদালতে চালান দিয়ে দিয়েছে। আদালতে নেওয়ার আগে থানায় ৩৯ ঘণ্টা রাখা হয়েছিল।

র‍্যাপার হান্নান
প্রশ্ন

কোন মামলায় আপনাকে আদালতে তোলা হলো?

হান্নান হোসাইন: আদালতে পাঠানোর আগেও আমি জানতাম না, আসলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী। পরে জেনেছি, আমার বিরুদ্ধে নাকি ভাঙচুর, বিস্ফোরণের মামলা দেওয়া হয়েছে। আদালতে আমাকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিল পুলিশ, দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। কারাগারে নেওয়ার পঞ্চম দিনে আমাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। তবে দুই দিনের রিমান্ডে আমার ওপর কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

প্রশ্ন

কারাগারের দিনগুলো কেমন ছিল?

হান্নান হোসাইন: আমি আগে কখনোই জেল দেখিনি। বিনা কারণে জেল খাটছি, এটা ভাবতেই খারাপ লাগত। বাইরে কী চলছে, জানতাম না। কখনো কারাগারে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎও বন্ধ ছিল। পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। পরে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। কারাগারে থেকেই শুনেছিলাম, আমার জন্য অনেকে রাস্তায় ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবেগে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।

র‍্যাপার হান্নান
প্রশ্ন

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট মুক্তি পেলেন। ১২ দিন বন্দী থাকার পর মুক্তির আনন্দটা কেমন ছিল?

হান্নান হোসাইন: মুক্তির আনন্দটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সেদিন সকাল ১০টার দিকে আমার মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধুরা আমাকে নিতে এসেছিলেন। বের হতে হতে বিকেল চারটা বেজেছিল।

প্রশ্ন

কারাজীবন নিয়ে কোনো গান করবেন?

হান্নান হোসাইন: কারাগারে থাকতেই ভেবেছিলাম, বের হয়ে আরেকটা গান রিলিজ দেব। ইতিমধ্যে ‘রিস্ক’ প্রকাশ করেছি। কারাজীবন নিয়েও একটা গান করছি, অর্ধেকটা লিখে ফেলেছি। মাসখানেকের মধ্যে গানটা প্রকাশিত হবে।

প্রশ্ন

অনেকে বলছেন, আন্দোলনের মধ্যে র‍্যাপ সংগীত নির্দিষ্ট শ্রোতাদের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে...

হান্নান হোসাইন: অনেক বয়স্ক মানুষ কখনোই র‍্যাপ গান শোনেননি, তাঁরাও শুনেছেন। এটা র‍্যাপ সংগীতের জন্য ইতিবাচক ঘটনা। অনেকে জানতেনও না, দেশে র‍্যাপ গানের অস্তিত্ব আছে। অনেক মুরব্বি ‘আওয়াজ উডা’ শুনে বলেছেন, তোমার গানটা ভালো লেগেছে। এই আন্দোলনে ‘কথা ক’, ‘বাংলা মা’, ‘বায়ান্ন’র মতো গান শুনলে রক্ত গরম হয়ে যায়। এসব গান আমার খুব ভালো লেগেছে।

র‍্যাপার হান্নান
প্রশ্ন

কবে থেকে গানে এলেন?

হান্নান হোসাইন: ২০১৮ সালে র‍্যাপ গান শুরু করেছি। ‘ডিসকাউন্ট’ শিরোনামে প্রথম গান করেছিলাম। এর পর থেকে টানা ছয় বছর র‍্যাপ সংগীত করছি। এর আগে একাধিক মিক্সড অ্যালবাম করেছি। সামনে প্রথম একক অ্যালবাম ‘হরেক মাল’ প্রকাশ করব। এতে নয়টির মতো গান থাকবে। আমার বড় ভাই সেজানের কাছ অনুপ্রাণিত হয়েছি। দুই বছর ধরে গানকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে। আগে নিজের জন্য করতাম, এখন মানুষের জন্য করছি।

প্রশ্ন

জন্ম ও বেড়ে ওঠা কোথায়?

হান্নান হোসাইন: জন্ম জুরাইনে, নানির বাড়িতে। বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। পড়াশোনা জুরাইন ও নারায়ণগঞ্জে।