কক্সবাজারের তরুণদের গানের দল পেনোয়া। চলতি বছর প্রথম অ্যালবাম এ রুহের তলে প্রকাশের পর আলোচনায় আসে ব্যান্ডটি। গানের কথা ও সুরের সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে তাঁদের মিউজিক ভিডিও। পেনোয়ার আদ্যোপান্ত জেনেছেন নাজমুল হক
‘যেন এক নিরাধার উপকূল এ হৃদয়/ শুধু ঢেউ আসে আর ফেরে না’। সৈকতে বসে ‘নিরাধার উপকূলে’ গানটি লিখেছেন ইয়াসির আরাফাত। লিখেছেন আরও অনেক গান। সারা সন্ধ্যা, কখনো–বা অনেক রাত পর্যন্ত লিখেছেন, সুর করেছেন রুদ্র। ‘আমি লিখি, সেই লেখায় সুর দেন রুদ্রদা। আমাদের এই জার্নির শুরু হয় আরও দুই-আড়াই বছর আগে। আমি তখন অনেক বছর পর কক্সবাজারে ফিরে আসি। একা একটা ঘরে বসে বসে ছবি আঁকতাম, লিখতাম। রুদ্রদা একদিন এসে বললেন, “লেখা দেন, সুর করব।” ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলত। আসলে গল্পই রুদ্রদার সুরের প্রধান বিষয়। কথার ভেতরের কথার গল্পও তাঁর জানা চাই। এভাবে শুরু, এখন অবধি আমরা দুজন ৩০টার মতো গান বেঁধেছি। রুদ্রদাই আমার প্রথম স্বপ্নসারথি এবং আমাদের প্রধান সুরকার ও গায়ক।’ আলাপে আলাপে পেনোয়ার সূচনার গল্প বলে দিলেন ইয়াসির আরাফাত।
পরে ব্যান্ডে যুক্ত হতে থাকেন আরও স্বপ্নসারথিরা। রথিন পালকে নিয়ে আসেন রুদ্র। শুরুতে তিনি রিদম সেকশনে ছিলেন আর গাইতেন। পরে সুর করাও শুরু করেন। প্রথম অ্যালবামের দুটি গানের সুর করেছেন রথিন। তবে এখন তিনি প্রধান গিটারিস্ট ও গায়ক। রথিনের হাত ধরে যুক্ত হন জিৎ। ড্রামার অনিন্দ্য পাল জিৎ ব্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। এ ছাড়া আছেন আবির; লিড গিটার বাজান। বেজ বাজাচ্ছেন রাসেল, গিটারে শুভ।
কথাই যেন পেনোয়ার অর্ধেক প্রাণ। ‘ভালোবাসতে তোমায় বলে বুদ্ধ পাখি/যে পাখির মতো মৌন তোমার সে আঁখি/ঘিরে রয়’, আবার কোনো গানে তারা বলছে, ‘ঋষিবৃক্ষ আমার বলো ভোর কত দূর/তারাদের সাথে আর কত দূর যাবে নাও!’ কিংবা, ‘প্রাইস-ট্যাগটা মূল্য দেখায় বেশ হাই/তেজপাতা দিয়ে যদিও জীবন কেনা যায়’। ইউটিউবে গানের নিচে মন্তব্যের ঘরে অনেক অনুসারী ব্যান্ডের গানের কথামালার প্রশংসা করেছেন। ‘আর অন্তরে যেন দুলছে কার মাজার/কারা করে কোলাহল বোবাদের জিকিরে!’ এমন কথা মুগ্ধ করেছে এ প্রজন্মের অনেক শ্রোতাকেই।
গানের কথা নিয়ে ইয়াসির বলেন, ‘আমাদের আঞ্চলিক, বাংলা ও বিশ্বগানে যে কী অসাধারণ সব লিরিক আছে, সেখানে নতুন করে কিছু যোগ করা খুব মুশকিল। দর্শনই আমাকে উৎসাহিত করছে গান লিখতে। মূলত গল্পকার আমি। ২০১৪ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ রোদকথা প্রকাশের ১০ বছর পর প্রকাশিত হয় এই সব গান। সংস্কৃত ছন্দ তোটক নিয়ে কাজ করেছি বেশ কিছু লিরিকে। তা ছাড়া আমার পরিবার ও সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার আমি করি আমার গানগুলোর কথায়। শব্দ তো আসলে খুব শক্তিশালী একটা মাধ্যম মানুষকে স্পর্শ করার। কথার মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চাই অস্তিত্ব ও জীবন, দর্শন, প্রাণের ইতিহাসের বয়ান।’
এর মধ্যে আড্ডায় যুক্ত হলেন ভগবান রুদ্র। তিনি শোনালেন শুরুর দিকের সংগ্রামের গল্প। কক্সবাজারে ভালো প্র্যাকটিস-প্যাড নেই। ছিল না কোনো মানসম্মত রেকর্ডিং স্টুডিও। এর মধ্যেও রুদ্রর কাছে এতদূর আসার কারণ নিবেদিতপ্রাণ দল। এ ছাড়া রুদ্র উল্লেখ করলেন প্রথম অ্যালবামের মিউজিক প্রডিউসার ফারমিন ফয়সালের কথা। এ ছাড়া জাকির হোসাইন লিমনের কথাও। তিনি নিজের তৈরি, পরীক্ষামূলক ও আদিবাসী যন্ত্র নিয়ে পেনোয়ার সঙ্গে আছেন। ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তানিম নওশাদ।
পেনোয়ার ভিডিও চিত্রগুলো আলাদাভাবে প্রশংসিত হয়েছে। প্রতিটি গানের দৃশ্যায়নেও রয়েছে ভিন্নতা। বিভিন্ন দৃশ্যে উঠে এসেছে কক্সবাজারের অদেখা সৌন্দর্য। ইয়াসির আরাফাতের কথায়, ‘তথাকথিত মিউজিক ভিডিও ঢঙে আমরা যেতে চাইনি। একটা প্যারালাল জার্নির মধ্য দিয়ে দর্শকদের নিতে চেয়েছি। যেখানে উঠে এসেছে অদেখা কক্সবাজার। আমরা একটা ভিজ্যুয়াল গল্প বলতে চেয়েছি।’ হালুয়া কনটেন্ট ও সেনশেন্ট—এই দুই প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করছে পেনোয়ার মিউজিক ভিডিওগুলোয়। ভিজ্যুয়াল সেকশনে কাজ করছেন আর্টিস্ট, গবেষক ও নির্মাতা পংকজ চৌধুরী রনি এবং মিউজিক প্রডিউসার ও নির্মাতা রাফায়েত নেওয়াজ। কবি ও গীতিকার, সমুদ্র সন্তান দেখছেন ব্র্যান্ডিং। তা ছাড়া আরও বেশ কিছু গীতিকার ও সুরকারকে নিয়ে কাজ করছে পেনোয়া।
গত ফাল্গুনে এ রুহের তলে অ্যালবাম দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে পেনোয়া। অ্যালবামের ১৩টি গানের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৭টি। ‘এ রুহের তলে’, ‘রাতের সাঁতার’, ‘কুহু ডাকের হন্’, ‘শুনতে যা চাও’ ও ‘ধ্যান নদী’ গানগুলো মুক্তির পর আলোচিত হয়েছে। বাকি ছয়টি গানসহ একসঙ্গে পুরো অ্যালবাম প্রকাশ পাবে স্পটিফাইয়ে। এ ছাড়া ১৩টা গানের আরও একটি অ্যালবাম তৈরি আছে। আগামী বছর সেটা মুক্তি পাবে।
‘পেনোয়া’র প্রথম গান ‘এ রুহের তলে’ নিয়ে চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নির্মাতা আখতানিন খাইর তানিন। এটি এখন আছে সম্পাদনার টেবিলে। বিশ্বব্যাপী বিষণ্নতার শিকার মানুষদের জন্য এই সিনেমা। নির্মাতা তানিন মনে করেন, ‘এ রুহের তলে’ গানটি বিষণ্নতায় ভোগা মানুষদের জন্য একটা ‘মিউজিক থেরাপি’ হতে