গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘পাকিস্তানে নষ্ট হচ্ছে আবদুল আলীমের গান’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
লোকগানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল আলীমের সংগীতসম্ভারের বহু গান এখনো অনাবিষ্কৃত রয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের মহাফেজখানায় আলীমের বহু গান অযত্নে পড়ে আছে। কূটনৈতিক জটিলতায় স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশকেও আলীমের গান ফেরানো যায়নি।
গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘পাকিস্তানে নষ্ট হচ্ছে আবদুল আলীমের গান’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরপর সরকারিভাবে গানগুলো ফেরানোর উদ্যোগ নিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে আবদুল আলীমের পরিবার।
প্রায় এক বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে চিঠি চালাচালির পর এই সপ্তাহে আবদুল আলীমের ১২টি গান হাতে পেয়েছে ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশন। গানগুলো রেডিও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ স্টেশনের বৈদেশিক সার্ভিস বিভাগে ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানান, গানগুলো ভিনাইল রেকর্ড আকারে ছিল। পরে সেখান থেকে ডিজিটালি রূপান্তর করে পেনড্রাইভে নেওয়া হয়। পেনড্রাইভে ১২টি গান ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগে পাঠানো হয়েছে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই সেটি ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ জানিয়েছে, আবদুল আলীমের গান বাংলাদেশের সম্পদ। গানগুলো ঢাকায় পৌঁছালে তা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
আবদুল আলীমের পরিবার জানিয়েছে, গান হাতে পাওয়ার পর তাঁরা একটি কপি সংরক্ষণ করবেন। গানের একটি কপি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও আরেকটি কপি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দিতে বলা হয়েছে।
১২টি গানের মধ্যে কোন কোন গান রয়েছে, তা এখনো জানাতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; হাতে পেলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবদুল আলীমের দেড় শ গানের একটি তালিকা দিয়েছেন; যেই গানগুলো রেডিও পাকিস্তানে থাকতে পারে। সেই তালিকা ধরেই ১২টি গানের খোঁজ মিলেছে; বাকি গানের খোঁজ চলছে।
আবদুল আলীমের মেয়ে সংগীতশিল্পী নূরজাহান আলীম গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল আলীমের গানের অনুরাগীদের জন্য এটি একটি সুখবর। এই ১২টি গানের মধ্যে বাবার পরিচিত গানের বাইরে নতুন গান থাকতে পারে, যেগুলো শ্রোতারা আগে শোনেননি।’
আবদুল আলীমের গান ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারের প্রতি ও বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করায় প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আলীম-কন্যা নূরজাহান আলীম। তাঁর আশা, আবদুল আলীমের বাকি গানও একদিন ফেরানো যাবে।
চলচ্চিত্র গবেষক শামসুল আলম মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি বাংলা গানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটি ঘটনা।’ আবদুল আলীমের জীবন ও কর্ম নিয়ে নূরজাহান আলীমের প্রযোজনায় ‘রঙ্গিলা নায়ের মাঝি’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন শামসুল আলম।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম আলোয় আবদুল আলীমকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সরকারিভাবে গানগুলো ফেরানোর উদ্যোগ নিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে আবদুল আলীমের পরিবার। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
বাংলাদেশ বেতার ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে গান ফেরাতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। গান ফেরাতে এই বছর মার্চ মাস থেকে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ। আবদুল আলীমের গান কোথায়, কীভাবে আছে, তা নিয়ে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করেছেন আবদুল আলীমের মেয়ে নূরজাহান আলীম ও জামাতা হিসান বাবু।
স্বাধীনতার আগে রেডিও পাকিস্তানে নিয়মিত বাংলা গানের অনুষ্ঠান হতো। সেই সূত্রে রেডিও পাকিস্তানে বহু গান করেছেন আবদুল আলীম, সেই গানগুলোর স্পুল রেডিও আর্কাইভে জমা রয়েছে। স্বাধীনতার পর আর গানগুলো উদ্ধার করা যায়নি।
বছরের পর বছর ধরে রেডিও পাকিস্তানের করাচি স্টেশনের মহাফেজখানায় পড়ে ছিল আলীমের গান। পরে সেগুলো ইসলামাবাদ স্টেশনের বৈদেশিক সার্ভিস বিভাগে নেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু গান নষ্ট হয়ে যায়, কিছু বাংলা গান এখনও বৈদেশিক সার্ভিস বিভাগে বাজানো হয়।
আবদুল আলীমের গাওয়া ‘পরের জায়গা পরের জমিন’ কয়েক বছর আগে একটি পাকিস্তানি সিরিয়ালে ব্যবহার করা হয়। গীতিকার আবদুল লতিফের কথায় আবদুল আলীমের কণ্ঠে গানটি দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের শ্রোতাদের মুখে মুখে ছড়িয়েছে।
অল্প বয়সেই গান গেয়ে নাম করেন লোকসংগীতের এই অমর শিল্পী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বের হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড। তাতে ছিল দুটি গান—‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ ও ‘আফতাব আলী বসল পথে’।
দেশভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন মুর্শিদাবাদের আবদুল আলীম। রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে থাকেন। এই ভূখণ্ডের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আবদুল আলীম গান করেছেন। ‘যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘দোল দোল দোলোনি’-এর মতো কালজয়ী গানে প্রাণ দিয়েছেন এই শিল্পী।
১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান আবদুল আলীম। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।