ঢাকায় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দীপু মালাকার
ঢাকায় অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দীপু মালাকার

‘ভিনদেশী তারা’র গল্প শোনালেন অনিন্দ্য

‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’—চন্দ্রবিন্দুর গানের মতোই ব্যান্ডটির গায়ক, গীতিকার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বই প্রকাশের অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে রইল ‘মুহূর্ত’। কাগজে-কলমে প্রকাশনা উৎসব হলেও কথা, আড্ডা আর গানে ভেসে গেল ‘আদরের নৌকা’।

গত সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ছিল ‘অনিন্দ্যকাল’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। নাম দেখে আন্দাজ করা শক্ত নয় বইটি লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গায়ক, গীতিকার ও নির্মাতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। বইটির লেখক সাজ্জাদ হুসাইন। অনিন্দ্যের অটোগ্রাফসহ বই কিনতে, কথা আর গান শুনতে এদিন হাজির হয়েছিলেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগীরা।

শুরুতে আলাপের সূত্রধর ছিলেন সাজ্জাদ। তিনিই একে একে প্রশ্ন পাড়েন, উত্তর দেন অনিন্দ্য। পরে ছিল উপস্থিত অনুরাগীদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব।

অনিন্দ্যর আলাপের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা গায়কের রসবোধ সম্পর্কে জানেন। উত্তর দিতে গিয়ে তিনি শ্রোতাদের কখনো নিয়ে গেলেন উত্তর কলকাতার এঁদো গলিতে, কখনো সন্ধ্যার বন্ধুদের আড্ডায়; কখনো আবার ভাসিয়ে দিলেন পুরোনো প্রেমের নস্টালজিয়ায়।

চন্দ্রবিন্দু তাঁদের অনেক গানের জন্যই পরিচিত, তবে ‘অন্তহীন’ সিনেমার পর তাঁর ‘ভিনদেশী তারা’র জনপ্রিয়তা ‘ভিনদেশ’ ছুঁয়েছে। ব্যান্ডের অ্যালবামে না-শোনা অনেক শ্রোতার কাছেও পৌঁছে গেছে অনিন্দ্যর গানটি। আলাপের শুরুতে তাই গায়কের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘ভিনদেশী তারা’ নিয়েই।

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। দীপু মালাকার

গানের মতোই গান নিয়ে অনিন্দ্যর গল্পও মুগ্ধ করে শ্রোতাদের। এদিনও ব্যতিক্রম হলো না।

‘এমনি যে-কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলি প্ল্যানেটারিয়াম থেকে বেরিয়ে এটা (‘ভিনদেশী তারা’) লিখেছিলাম।’ স্বভাবসুলভ রসিকতায় শুরু করেন অনিন্দ্য। হলভর্তি দর্শক তখন হেসে খুন।

এরপর গানটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানান তিনি। বলতে থাকেন, ‘এমনিতে ভিনদেশ মানে একটা জায়গা থেকে অন্য আরেকটা জায়গায় যাওয়া। ভিনদেশ মানে ভৌগোলিক সীমারেখা, পাসপোর্ট বা ইমিগ্রেশন নয়; ভিনদেশ হলো আমি যেখানে বড় হয়েছি, যেখানে আমার সত্তা, মন, ভালোবাসা; সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া। এখানে আমরা যারা রয়েছি, সবারই জীবনের গতিপ্রকৃতি অনেকটা তা-ই। আমরা একটা জায়গায় বড় হই, আরেকটা জায়গায় বাস করি। যেখানে বাস করি, সেখান বসে সারাক্ষণ দেখার চেষ্টা করি ছেলেবেলায় আমরা যে গাছটা দেখেছিলাম সেটা আদৌ আছে কি না, আমাদের স্কুল-বাড়িগুলো কতটা আমাদের মাপের চেয়ে ছোট হয়ে গেল; ফলে সেটাও কিন্তু একটা ভিনদেশ। যে জায়গায় বহু বছর ধরে যাই না, সেটাও আমার কাছে একটা ভিনদেশ।’

শুনতে সবাই যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন যাঁর যাঁর ‘ভিনদেশ’-এ। সংবিৎ ফিরে পেল অনিন্দ্যর পরের কথায়, ‘“ভিনদেশী তারা’ গানটা অবশ্যই একটা প্রেমের গান; তা যতই সৌরজগৎ নিয়ে কথা বলি না কেন। যার সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ আছে। বোঝা এমন একটা ভালোবাসার গান, যার কাছে আমি আর পৌঁছাতে পারছি না। তাঁর সত্যই খুব আকাশছোঁয়া বাড়ি, যে বাড়ির নাগাল আমার করায়ত্ত নয়।’

অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় ও সাজ্জাদ হুসাইন। দীপু মালাকার

কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইতে এসেছিল চন্দ্রবিন্দু। সেখানে ৪০ হাজারের বেশি দর্শক-শ্রোতা একসঙ্গে ‘ভিনদেশি তারা’ গান, যা অবাক করেছে গায়ককেও। কারণ, সেই কনসার্টে হাজির দর্শকের প্রায় সবারই বয়স খুব কম। গানটির মধ্যে থাকা ‘প্রেমহীনতা’ তাঁদের ‘ভিনদেশী তারা’র সঙ্গে একাত্ম করেছে বলে মনে করেন অনিন্দ্য। তিনি আরও মনে করেন, গানটির সোজা সরল গতির কারণে মানুষের মনে গেঁথে গেছে।

কথায় কথায় অনিন্দ্য জানান, ‘ভিনদেশী তারা’ লেখার সময়কালের গল্প। ‘এটা একান্তই নিজের একটা প্রেমের গান তো, প্রথমবার কম্পোজ করার পর খুব লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল—গানটা গাইব লোকের সামনে! মনে হচ্ছিল, সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে যাব। উপল, চন্দ্রিলকে (চন্দ্রবিন্দুর দুই সদস্য) বললাম, একটা গান বানিয়েছি; আমার জন্যই কিছুটা বানানো। রেকর্ড করতে হবে তার মানে নেই। শোনার পর সবাই দেখি চুপচাপ বসে আছে। তখন আরও নার্ভাস হয়ে গেছি। তার মানে, বোধ হয় গানটা একেবারেই দাঁড়ায়নি। পরে চন্দ্রিল বলল, “এটা যদি রেকর্ড না করা হয় খুব অন্যায় হবে।” সবাই তারপর সুর মেলাল। রেকর্ড করার পর এতটা ব্যক্তিগত একটা গান যে এতটা সর্বজনীন হয়ে যেতে পারে, এটা আমার জীবনের খুব আশ্চর্য ঘটনা,’ বলেন অনিন্দ্য।

এদিনে আলাপে আলাপে উঠে আসে অনিন্দ্যর ছেলেবেলা, বড় হওয়ার গল্প। তেমনি উঠে আসে ‘বন্ধু তোমায়’, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’সহ আরও অনেক গানের গল্প।
আলাপে আলাপে সময় গড়ায়, তবু গল্প ফুরায় না। মনে থাকে শুধু ‘মুহূর্ত’। অবচেতন মনে বাজতে থাকে গানটাও, ‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’।