হামিদা বানু
হামিদা বানু

অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে জেল খেটেছেন, গানই জেলমুক্ত করেছিল তাঁকে

জীবিকার তাগিদে আড়াই মাসের সন্তানকে বুকে নিয়ে দিল্লির পথ ধরেছিলেন তিনি। তবে বিনা পাসপোর্টে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে বছর চারেক জেল খেটেছেন। জেলজীবনেও সংগীতচর্চা করেছেন, গান তাঁকে জেল থেকে মুক্ত করেছিল। কোক স্টুডিও বাংলার ‘দিলারাম’ গেয়ে পরিচিতি পাওয়া সংগীতশিল্পী হামিদা বানু।

কাঁটাতারের ওপারে মেঘালয়, এপারে পাহাড়ঘেরা সুনামগঞ্জের বনগাঁও। সীমান্তঘেঁষা এই গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হামিদা বানুর। বাবা লাল মিয়া বয়াতি গানের মানুষ। শৈশব থেকেই বাবার সঙ্গে মেলা, ওরস–মাহফিলে গান করতেন। বাউল শাহ আবদুল করিমের সান্নিধ্যও পেয়েছেন তিনি।

গানের সঙ্গে শৈশব পেরোলেও কৈশোর পেরোতে পারেননি হামিদা। গ্রামের মানুষেরা বলাবলি করতে থাকলেন, ‘মেয়ে বড় হয়েছে; বিয়ে দিতে হবে।’ মাত্র ১৬ বছর বয়সে হামিদার বিয়ে হয়। পাত্র নারায়ণতলা গ্রামের সামাদ উল্লাহর ছেলে শুকুর আলী। বিয়ের পর স্বামী বলে দিলেন, গান-বাজনা চলবে না!
হামিদা বাঁধা পড়লেন সংসারের বেড়াজালে। টানাটানির সংসারে সুর সামলানোর ফাঁকতালে সংগীতে ছেদ ঘটে। বিয়ের বছরই মাকে, পরের বছর বাবাকেও হারান হামিদা। তাঁর জীবনে আনন্দ যোগ করেছিল প্রথম সন্তান সোহেল, জন্মের ছয় মাসের মাথায় মারা যায় সোহেলও।
বহু বছর পর হামিদার সংসারে দ্বিতীয় সন্তান আসে। সন্তানের নাম রাখেন আল আমিন। হামিদার সংসারে অনাহূত অতিথি ছিল ‘অভাব’। ভাতের কষ্টে জর্জর হামিদার সংসার, জীবিকার তাগিদে আড়াই মাসের সন্তানকে বুকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ভারতে কাজ পাওয়া যায়; রোজগারও মন্দ নয়—এমন ভরসায় দিল্লির পথ ধরেন তাঁরা।

শুকুর ও হামিদার পাসপোর্ট নেই। বিএসএফ জওয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেও দিল্লি যেতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আটকা পড়েন। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে বহরমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ঠাঁই মেলে স্বামী-স্ত্রীর। নারী সেলে হামিদা, পুরুষ সেলে শুকুর আলী। আর দুধের শিশু আল আমিনের আশ্রয় মেলে কলকাতায় শুকুরের এক আত্মীয়ের বাসায়। কোলে চড়ে সপ্তাহে সপ্তাহে মা-বাবাকে দেখে যেত একরত্তি আল আমিন।

কোক স্টুডিও বাংলার মঞ্চে হামিদা বানু
শুকুর ও হামিদার পাসপোর্ট নেই। বিএসএফ জওয়ানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেও দিল্লি যেতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের মালদহে আটকা পড়েন। পাসপোর্ট ছাড়া ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে বহরমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ঠাঁই মেলে স্বামী-স্ত্রীর

চার দেয়ালে বন্দী কারাগারে গান গাওয়ার স্বাধীনতা মেলে হামিদার। গান গেয়ে কয়েদিদের মধ্যে পরিচিতি পান। চৌদ্দ শিক পেরিয়ে জেল সুপারের কানেও পৌঁছে যান হামিদা, তিনি ছিলেন সংগীত অনুরাগী। কয়েদি হলেও তাঁর কাছে একধরনের আশকারা পান হামিদা। কারাবন্দী অবস্থায় কাটে চার বছর। কয়েদি মা আর আল আমিনের বয়স প্রায় সমান। মা-বাবার মুক্তির অপেক্ষায় থাকে আল আমিন। হামিদা বানু জানেন, তাঁকে আরও আট বছর জেলেই থাকতে হবে। তারপর? প্রতিবছর দুর্গাপূজায় কয়েদিদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। টানা তিন বছর গান করছেন হামিদা, এবারও গাইবেন। এবার বহরমপুর কারাগারে আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শাহ আবদুল করিমের ‘রঙের দুনিয়া তোরে চাই না’, হাসন রাজার ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে’ পরিবেশন করলেন হামিদা। গান শুনে মুগ্ধ হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

হামিদা বানু গত রোববার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গান শুনে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘তুমি কী চাও?’ আমি বললাম, ‘আমাদের মুক্তি দেন, আমরা দেশে ফিরতে চাই। তিনি আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’

দুর্গাপূজার পরপরই স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত হয়ে দেশে ফেরেন হামিদা। তাঁরা নারায়ণতলার বাড়িতে ওঠেন। জেল খাটার অপবাদ দিয়ে হামিদাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ও বাড়িতে টিকতে না পেরে ভারত থেকে ফেরার মাস তিনেক পর আবারও স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়েন।
আর দিল্লি নয়, এবারের গন্তব্য জম্মু ও কাশ্মীর। এবার আর পুলিশের জালে পড়তে হয়নি, সোজা জম্মুতে পৌঁছে যান। জম্মুর কালাকোটে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। ছেলে আল আমিনকে নিয়ে বাড়িতে থাকতেন শুকুর আর বোতল কুড়াতেন হামিদা। বোতল বিক্রির টাকায় টেনেটুনে সংসার চলছিল। প্রায় এক বছর পথে পথে ঘুরে একটি ওষুধের কারখানায় কাজ পান হামিদা। ওষুধ রাখার জন্য ব্যবহৃত বক্স বানাতেন, মাইনে দিয়ে সংসারেও খানিকটা ছন্দ ফিরেছিল।

‘গান শুনে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘তুমি কী চাও?’ আমি বললাম, ‘আমাদের মুক্তি দেন, আমরা দেশে ফিরতে চাই। তিনি আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’
প্রায় চার বছর ধরে হাসন রাজা মিউজিয়ামে কাজ করছিলেন হামিদা বানু

কালাকোটে প্রায় পাঁচ বছর কেটেছে হামিদা-শুকুর দম্পতির। এর মধ্যেই তাঁদের মেয়ে সোয়ানার জন্ম হয়। সন্তানদের জন্য একটু বাড়তি দুধ ও ডিম কেনার সামর্থ্য হয়েছিল হামিদার। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের নারায়ণতলা থেকে ফোন আসে শুকুর আলীর কাছে, তাঁর বাবা তাঁদের গ্রামে ফেরানোর জন্য জোরাজুরি করেন। নারায়ণতলায় ফিরে আসেন। তবে হামিদার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা তিনি জানতেন না।

দেশে ফেরার সপ্তাহখানেকের মাথায় শুকুর আলীর ভোল পাল্টে যায়, মা–বাবার যোগসাজশে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। হামিদাকে বাড়িছাড়া করা হয়। দুই সন্তান নিয়ে হামিদা কোথায় যাবেন? শৈশবের বনগাঁও? মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই, দুই বোনও বিয়ে করে সংসার করছেন। বনগাঁওয়ে ফেরার পথ নেই আর নারায়ণতলায় থাকার উপায় নেই।

ঠিকানাহীন হামিদা দুই সন্তানকে নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, একা লড়াই করে গেছেন। ঘাত-প্রতিঘাতে সন্তানদের আগলে রেখেছেন। মাঝে কিছুদিন সুরমা নদীতে শ্রমিকের কাজ করেছেন হামিদা, বালুভর্তি বস্তা ট্রলারে ফেলতেন। অমানুষিক পরিশ্রমের মধ্যেও সংগীত চর্চা করে গেছেন হামিদা, সংগীতের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন।

জেল খাটার অপবাদ দিয়ে হামিদাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ও বাড়িতে টিকতে না পেরে ভারত থেকে ফেরার মাস তিনেক পর আবারও স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়েন।
গান গেয়ে কয়েদিদের মধ্যে পরিচিতি পান হামিদা বানু

মেলায়, ওরস–মাহফিলে গান করা শুরু করেন। ফাঁকে ফাঁকে কাজ খুঁজছিলেন, খুঁজতে খুঁজতে হাসন রাজার প্রপৌত্র ও গবেষক সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হামিদার। হামিদাকে মিউজিয়ামের কর্মচারী হিসেবে কাজ দেন তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাসন রাজার গান চর্চা করেন। হাসন রাজার দুই শতাধিক গান গাইতে পারেন হামিদা।

হাসন রাজা মিউজিয়ামে গিয়ে হামিদার কণ্ঠে ‘দিলারাম’ গানটি ধারণ করে প্রকাশ করেন গীতিকবি সেজুল হোসেন। সেটি কোক স্টুডিও বাংলার প্রযোজক অর্ণবের নজরে আসে, পরে হামিদাকে দিয়ে কোক স্টুডিও বাংলায় গানটি গাওয়ান। ৯ সেপ্টেম্বর গানটি প্রকাশের পর রাতারাতি দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন হামিদা বানু।
সেই আড়াই মাসের আল আমিন এখন ১৬ বছরের কিশোর। জম্মুতে একটি ওষুধ কারখানায় কাজ করে। আট বছর বয়সী সোয়ানাকে নিয়ে সুনামগঞ্জে আছেন হামিদা বানু। প্রায় চার বছর ধরে হাসন রাজা মিউজিয়ামে কাজ করছিলেন ৪৭ বছর বয়সী হামিদা। ভালোই চলছিল তাঁর, গত বছর বন্যায় মিউজিয়ামটি বন্ধের পর রুটিরুজি নিয়ে আবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন তিনি।
খেয়ে পরে বাঁচতে সামারীন দেওয়ানের বড়পাড়ার বাসায় কাজ করছেন, মেয়েকে নিয়ে আপাতত তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছেন। হামিদা বানু স্বপ্ন দেখেন, একদিন নিজের একটা ঠিকানা হবে। ছেলেমেয়েকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবেন। সঙ্গে থাকবে হাসন রাজার গান।