সলিল চৌধুরী
সলিল চৌধুরী

আলোর পথযাত্রী সলিল চৌধুরীর জন্মদিন আজ

গণমানুষের বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। সহজ কথায় গানে গানে প্রান্তিকজনকে সংহতির ডাক দিয়েছেন তিনি। তাঁর গানে উঠে এসেছে সমাজের অসংগতির কথা। আজ তাঁর জন্মদিন।
সলিল চৌধুরীর জন্ম আসামে, ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। গীতিকার ও সুরকার। আট ভাই-বোনের মধ্যে সলিল চৌধুরী ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন চা–বাগানের চিকিৎসক। তিনি প্রচণ্ড ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন। কথিত আছে, ইংরেজ ম্যানেজার একদিন তাঁকে ‘ইউ ডার্টি নিগার’ বলে গালি দিয়েছিলেন, তখন তাঁকে ঘুষি মেরে তাঁর কয়েকটি দাঁত তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন। সংগীতজ্ঞ পিতা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরীর চা–বাগানের ঘন সবুজ পরিবেশে সলিল চৌধুরীর গানে হাতে খড়ি। তাঁর পরিবারের সংগ্রহে ছিল পশ্চিমা সংগীতের বিশাল ভান্ডার। শিশু সলিল চৌধুরী সেগুলো শুনে শুনে তৈরি হয়েছেন। তিনি পিতৃব্য নিকি চৌধুরীর কাছেও সংগীতে তালিম গ্রহণ করেছেন। স্কুল শেষে কলকাতায় পড়তে এসে ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে।
স্নাতক পড়াকালীন ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ) যোগ দিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রচুর কাজ করেন।

এই সাংস্কৃতিক দলটি ভারতের প্রত্যন্ত নানা এলাকায় গান গেয়ে মানুষকে সচেতন করার এক বিশাল ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান লিখে সুর করেন, যা এক বিস্ময়কর ব্যাপার বটে।
তাঁর সম্বন্ধে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আমার দেখা অন্যতম সেরা শিক্ষিত কম্পোজার।’ আর শচীন দেববর্মন তো একদিন সলিল চৌধুরীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেই ফেলেছিলেন, ‘দেখ সলিল, পঞ্চম (রাহুল দেববর্মন) তো আমার গান শোনে না। ও সারা দিন তোমার গান শোনে।’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সলিল চৌধুরীর জন্ম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সলিল চৌধুরী ৭৫টির বেশি হিন্দি সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেন। এ ছাড়া তাঁর ৪৫টি বাংলা সিনেমা, ২৬টি মালয়ালাম সিনেমা, কিছু তামিল, তেলেগু, কানাড়া, গুজরাটি, অসমিয়া ও উড়িয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। তাঁর কিছু কালজয়ী সংগীত সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, মাইকেলের ‘রেখ মা দাসেরে মনে’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পাল্কির গান’, বিমল ঘোষের ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’ প্রভৃতি কবিতায় ও গানে সুর সংযোজন করেন।

যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় ‘বিচারপতি তোমার বিচার’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘জন্মভূমি’, ‘হাতে মোদের কে দেবে’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’, ‘কালো মেয়ে’, ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে’ ও ‘শান্তির গান’ প্রভৃতি অনবদ্য স্মরণীয় গান রচনা ও সুরকার হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।

সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরী ঠিক কতগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন, তা বলা মুশকিল। তবে ছয়–সাতটি যন্ত্র অনায়াসে বাজাতেন। তার মধ্যে বাঁশি, অ্যাকর্ডিয়ান, পিয়ানো, গিটার, ম্যান্ডলিন ও সেতার। অথচ কারও কাছে শেখেননি—স্বশিক্ষিত। তাঁর সুরারোপিত গান গেয়ে ভারতের যেসব কণ্ঠশিল্পী অমর হয়েছেন, তাঁরা হলেন মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, যিশু দাস, সুশীলা, গীতশ্রী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
সলিল চৌধুরীর কণ্ঠে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’, ‘মনের বসন্ত এসো’, ‘ও গা গা রে পাখি গা’, ‘সাত ভাই চম্পা জাগো’ প্রভৃতি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘রানার’, ‘ধিতাং ধিতাং বলে’, ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’, ‘পথ হারাবো বলেই পথে নেমেছি’, ‘দুরন্ত ঘূর্ণির ঐ লেগেছে পাক’ প্রভৃতি বাংলা গানের রাজ্যে সেরা গান হিসেবে স্বীকৃত। তিনি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন। ‘পরিবর্তন’, ‘মধুমতি’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘মায়া’, ‘কাবুলিওয়ালা’ প্রভৃতি ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

ভারতীয় সংগীতে কয়্যার অর্কেস্ট্রেশনের সার্থক রূপকার তিনি। ২০০ শিল্পীকে সমবেতভাবে গান গাইয়েছেন একটুও এদিক-সেদিক না করে। বম্বে কয়্যার, কলকাতা ইয়ুথ কয়্যার সলিল চৌধুরীর সৃষ্টি।

সলিল চৌধুরী

ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর দুই কন্যা ও স্ত্রী। স্ত্রী সবিতা চৌধুরী একজন স্বনামধন্য শিল্পী ও কন্যা অন্তরা চৌধুরীও একজন স্বনামধন্য শিল্পী। আরেক কন্যা সঞ্চারি চৌধুরী প্রবাসে জীবন যাপন করছেন।
গত শতাব্দীর দীর্ঘ সময় ধরে তিনি গণমানুষের গান করে এই ভূখণ্ডের মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। উপহার দিয়েছেন একের পর এক অবিস্মরণীয় গান। পেয়েছেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই বিস্ময়কর বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে। আজ জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করি, শ্রদ্ধা জানাই।