বছরখানেক পর কনসার্টে ফিরেছে অর্থহীন, আসছে ব্যান্ডটির নতুন অ্যালবাম ‘ফিনিক্সের ডায়েরি ২’। ২ অক্টোবর উত্তরার অর্থহীনের স্টুডিওতে প্রথম আলোর সঙ্গে আড্ডা দিলেন ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা, বেজ গিটারিস্ট, ভোকালিস্ট সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন; শ্রোতাদের কাছে যিনি ‘বেজ বাবা’ সুমন নামে সমধিক পরিচিত। সঙ্গে ছিলেন ড্রামার মার্ক ডন। আড্ডার সূত্রধর ছিলেন মকফুল হোসেন
শরীরে একের পর এক অস্ত্রোপচার নিয়ে সাড়ে চার বছর আগে আপনি গানে ফিরেছেন। গানে ফেরার গল্পটা দিয়ে আমরা আলাপ শুরু করি।
সুমন: ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার কয়েক বছর পর কার অ্যাক্সিডেন্ট করি। আমার স্পাইন (মেরুদণ্ড) প্রায় ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। বিছানায় পড়ে গেলাম। নয় বছর বিছানাগত ছিলাম। এর মধ্যে তিন বছর কনসার্ট করতে পারছি। তখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম; কিন্তু বসে থাকতে পারতাম না। বসে থাকতে না পারলে একটা মানুষ গিটার বাজাতে পারে না, অফিস করতে পারে না, রেকর্ডিং করতে পারে না, গাড়ি চালাতে পারে না, গাড়ির পেছনে বসেও থাকতে পারে না। বসে থাকতে না পারলে একটা মানুষের জীবন শেষ। ১৫ মিনিট বসে থাকলে ব্যথায় চিৎকার করে উঠতাম। সারা দিন পেইন কিলার (ব্যথানাশক) ইনজেকশন দিত, প্রথম চার বছর আমি কিছুই করতে পারিনি।
চার বছর পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে বাইরে নেওয়া হয়। ওখানে গিয়ে ব্রেনে (মস্তিষ্ক) টিউমার পেল, এর মধ্যে স্ট্রোক করে শরীরের বাঁ অংশটা প্যারালাইজড হয়ে গেল। এত কিছুর পরও আমার মনোবল ছিল, তিন মাসের মধ্যে খানিকটা সেরে উঠতে লাগলাম। যখন দেখলাম ১৫ মিনিট বসতে পারছি, তখন ভাবলাম, আমি মিউজিক করতে পারব। অর্থহীনের সদস্যদের নিয়ে গানে ফেরার পরিকল্পনা করলাম।
২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে বামবার কনসার্ট দিয়ে চার বছর পর মিউজিকে ফিরলাম। স্টেজে ওঠার আগে একটা ছেলে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করেছিল, আমি যেন ‘অসমাপ্ত’ গাই। ওকে বললাম, ‘গানটা আমরা প্র্যাকটিস করিনি।’ পরে স্টেজে উঠে বললাম, ‘একটি ছেলে “অসমাপ্ত” গাইতে অনুরোধ করেছিল, আমাদের প্র্যাকটিস নাই, তবু গানটা গাইব।’ গানটা শুরু করতেই সামনে ৪০ হাজার লোক পুরো চট্টগ্রাম শহর কাঁপিয়ে ফেলেছে। আমার গানটা গাইতে হয়নি। ফ্যানদের এই লয়্যালিটির কথা ভেবে এখনো আমার চোখে পানি চলে আসছে। এটা অবিশ্বাস্য!
আমার যত টাকা কিংবা ফেমই থাকুক; এটা (ভালোবাসা) আমি কিনতে পারব না। ওই দিন আমরা বুঝেছিলাম, মানুষ আমাদের কতটা মিস করেছে। তার পর থেকে আর কোনো কনসার্টে ‘অসমাপ্ত’ গাইতে হয়নি। মাইক ঘুরিয়ে দিই, মানুষেরা গায়। এখন তো আমাকে ‘এপিটাফ’-ও গাইতে হয় না।
বাইরের একটা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আমাদের জানিয়েছে, ‘অসমাপ্ত’ অর্থহীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের একটাও না। ‘চাইতে পারো ১’, ‘চাইতে পারো ২ ’, ‘আমার প্রতিচ্ছবি’, ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’, ‘এপিটাফ’; অর্থহীনের জনপ্রিয় গানের তালিকায় ‘অসমাপ্ত’ আরও পরে। ওরা বলল, ‘এই গানগুলো স্টেজে গাইলে তোমাদের গাইতে হবে না। কনসার্ট করে চলে আসতে পারবা। শুধু তোমাকে একটু বেজ বাজাতে হবে আর মিউজিশিয়ানদের একটু কষ্ট করতে হবে। গাইতে হবে না। তোমাদের ফ্যানেরা এতটা লয়্যাল।’ ফেরার পর অর্থহীন অন্য জায়গায় চলে গেছে।
সেটা কীভাবে
সুমন: আমরা পরিকল্পিতভাবে ফিরেছি। ব্যান্ডে কোনো সদস্য নিলে প্রথমেই বলি, ফেম (খ্যাতি) ও টাকার জন্য অর্থহীনে আইসো না। তাহলে ধরা খাবা। আরেক জিনিস হচ্ছে, নো ড্রাগস। ড্রাগে আসক্ত হলে চলবে না। এই নিয়মগুলো মানতে বলি।
আরেকটা কড়া নিয়ম আছে, অর্থহীনে গণতন্ত্র বলে কিছু নাই। এটা একনায়কতান্ত্রিক ব্যান্ড। আমি এটা চালাই, আমি যেভাবে বলব, ওইভাবেই চলতে হবে। কিন্তু আমি কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে বৈঠক করব। সবার কথা শুনে আমি একটা সিদ্ধান্তে আসব। ওই ডিসিশন নিয়ে বাকি তিনজনের মধ্যে একজন হয়তো বা খুশি হবে না, দুইজন হয়তো খুশি হবে। চারজন খুশি হবে, এভাবে জীবন চলে না। এভাবে একটা দেশ, কোনো প্রতিষ্ঠান চলে না, এভাবে ব্যান্ডও চলবে না। ওইভাবে ব্যান্ড চালাতে গেলে, ব্যান্ড ভেঙে যাবে। আমার কথা শুনতে হবে।
ফেরার সময় সদস্যদের বলেছিলাম, অর্থহীন নিয়ে ফেরার একমাত্র কারণ আমাদের ফ্যান। চার বছর অর্থহীন ছিল না, ফ্যানরা অর্থহীন ভোলেনি। ফ্যানরা বারবার জানতে চেয়েছে, আপনি সুস্থ হবেন কবে? কবে কনসার্ট করবেন, এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা শুধু চেয়েছে, আমি আগে সুস্থ হই।
এরপর ভাবলাম, এদের কিছু একটা ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা জানি, এখন অ্যালবামের যুগ নেই। তারপরও বলছি, আমরা দুটো অ্যালবাম দেব। লোকসান যাবে যাক, স্পন্সর পাই বা না পাই; অ্যালবাম করব। আর কয়েকটা কনসার্ট করে দেব। কনসার্টগুলো কনসার্ট হবে না, একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে।
অর্থহীনে গণতন্ত্র বলে কিছু নাই। এটা একনায়কতান্ত্রিক ব্যান্ড। আমি এটা চালাই, আমি যেভাবে বলব, ওভাবেই চলতে হবে। কিন্তু আমি কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে বৈঠক করব।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
আরেকটু অতীতে ফিরি। ফিলিংস থেকে ওয়ারফেইজে গেলেন, ওয়ারফেইজ থেকে বেরিয়ে অর্থহীন করলেন। সেই সময় অর্থহীনকে আন্ডারগ্রাউন্ডে গান করতে দেখা গেছে।
সুমন: অনেকের ধারণা, আগে অর্থহীন হেভি মেটাল ছিল; এখন এসে একটু সফট হয়েছি। অথচ, ব্যাপারটা একদম ভুল। আগে আমাদের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ গান সফট ছিল, বাকি গানগুলো ছিল হেভি মেটাল। এসব গান নিয়ে যখন কনসার্ট করতে গেলাম, তখন বিশেষ একটা ব্যান্ড বলা শুরু করল, অর্থহীনকে না নিলে ভালো হয়। কেউ কেউ বলল, অর্থহীন থাকলে তারা থাকবে না। আয়োজকেরা বড় ব্যান্ড ফেলে অর্থহীনকে রাখবে কেন? একের পর এক কনসার্ট থেকে অর্থহীনকে বাদ দিতে থাকল।
পরপর তিনবার এমন ঘটনা ঘটার পর মনে হলো, প্রতিটি কনসার্টেই কমন একটা বা দুটি ব্যান্ড ছিল। তখন বুঝলাম, তারা চায় না আমরা কনসার্ট করি, মেইনস্ট্রিমে আসি। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, আন্ডারগ্রাউন্ডের ছোট ব্যান্ডগুলোকে টেনে তোমাদের জায়গায় নিয়ে যাব। তখন দেখি তোমরা কোথায় যাও? জয় নামে আমার এক বন্ধু তখন আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্ট আয়োজন করত। আমরা ওকে বললাম, অর্থহীন আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্ট করবে।
অর্থহীন তখন সিনিয়র ব্যান্ড, অর্থহীনকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পারফর্ম করতে দেখে তোলপাড় অবস্থা হয়েছিল। এর আগে আমি ওয়ারফেজে, ফিলিংসে বাজিয়েছি, আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে এসে পারফর্ম করছি বলে কেউ কেউ অবাকও হয়েছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্টে আমাদের হেভি মেটাল গানের সঙ্গে মেগাডেথ, মেটালিকার গান করতাম। আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ডগুলো নিয়ে মিক্সড অ্যালবাম করেছি, সেসব অ্যালবামে আমাদের হেভি মেটাল গান বেশি ছিল।
কনসার্টে নিয়মিত হেভি মেটাল গাইলেও আমাদের প্রথম অ্যালবাম ত্রিমাত্রিক, দ্বিতীয় অ্যালবাম বিবর্তন-এর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ গানই সফট ছিল। অ্যালবামের বাকি গান ছিল মেটাল। বিবর্তন বের করার পর মেগা হিট করল। ওই সময় আমরা মেইনস্ট্রিমে চলে যাই। তত দিনের আমাদের ওপর আন্ডারগ্রাউন্ডের সিল পড়ে গেছে। এ পর্যন্ত যতগুলো অ্যালবাম করেছি, সব হিসাব করলে দেখা যাবে, অর্থহীনের ৬৫ শতাংশের মতো গান সফট। বাকি ৩৫ শতাংশের মতো হেভি মেটাল বা হার্ড রক।
আমাদের দুই ধরনেরই ফ্যান আছে। আমরা কনসার্টে ‘নিকৃষ্ট’ গাইতেছি, মানুষজন চিৎকার করে ফাটিয়ে ফেলছে। সেই কনসার্টে ‘এপিটাফ’ করলে মানুষজন কাঁদছে। আমরা সব সময় রেলেভেন্ট (প্রাসঙ্গিক) থাকতে চেয়েছি। দিন বদলাচ্ছে, মানুষের রুচি পরিবর্তন ঘটছে। রেকর্ডিংয়ে পরিবর্তন ঘটছে, বাজানোর স্টাইলে পরিবর্তন ঘটছে। ফলে আমাদেরও পরিবর্তন হতে হবে। দেখবেন, আমাদের ত্রিমাত্রিক ও ফিনিক্সের ডায়েরি ১ অ্যালবামের ধরন আলাদা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও পরিবর্তন করেছি।
তখন বিশেষ একটা ব্যান্ড বলা শুরু করল, অর্থহীনকে না নিলে ভালো হয়। কেউ কেউ বলল, অর্থহীন থাকলে তারা থাকবে না। আয়োজকেরা বড় ব্যান্ড ফেলে অর্থহীনকে রাখবে কেন? একের পর এক কনসার্ট থেকে অর্থহীনকে বাদ দিতে থাকল।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
‘অদ্ভুত সেই ছেলেটির’র মতো গানকে অর্থহীনের ‘সিগনেচার’ গান বলা হয়; অর্থহীনের এ ধরনের গান নব্বইয়ের দশকের শ্রোতারা শুনতে চান। তবে ‘সিগনেচার’ ধারায় আটকে না থেকে ক্রমেই অর্থহীনের দৃশ্যত বিবর্তন ঘটেছে।
সুমন: অনেকে বলেন, সুমন ভাই, ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’, ‘কৃষ্ণচূড়া’র মতো গান আর করেন না কেন? আপনাদের গান আর ভালো লাগে না। ওনারা নব্বইয়ের ডাই হার্ড ফ্যান। তবে এখন কনসার্টে যায় না।
এখন জেন–জিরা কনসার্টে যায়, ওদের গান দেব। ওরা এখন সিনে (দৃশ্যপটে) আছে, ওরা গান শুনছে। আমি ওদের জন্য গান করব। ওরা একদিন বুড়া হয়ে বলবে, সুমন ভাই, আপনাদের ফিনিক্সের ডায়েরি ১ অ্যালবামের গানগুলো জোশ ছিল। এখনকার গানগুলো কেমন যেন লাগছে। আমি ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, তবে বলব, সরি। এভাবেই চলছে এখন।
স্পটিফাইয়ের তথ্য বলছে, আমাদের ১০ শতাংশ ফ্যানের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। এটা কেউ বিশ্বাস করবে? আমাদের বয়স যখন ১৪ বছর ছিল, তখন আমরা ৫০+ কোনো বুইড়ারে আইডল হিসেবে মানছি? ও স্টেজে উঠলে ‘বেজবাবা’, ‘বেজবাবা’ বলে চিৎকার করব কেন, ওর গান শুনে কাঁদব কেন? কিন্তু ওরা এটা করছে কারণ আমরা রেলেভেন্ট থাকতে চেয়েছি।
আমি স্টেজে গিয়ে কথা বললে ওরা আমার কথা ধরতে পারছে। আমি যখন বলছি, আমি এখন একটা ‘ফ্লেক্স’ করি? তখন ওরা বলছে, সুমন ভাই ‘ফ্লেক্স’ শব্দটা ব্যবহার করেছে? ওয়াও!
এখন জেন–জিরা কনসার্টে যায়, ওদের গান দেব। ওরা এখন সিনে (দৃশ্যপটে) আছে, ওরা গান শুনতেছে। আমি ওদের জন্য গান করব।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
‘ফিনিক্সের ডায়েরি ১’ অ্যালবামে নতুন একটি ধারা নিয়ে আপনারা নিরীক্ষা করেছেন। অর্থহীন এই ধারার নাম দিয়েছে, ‘বাংলা ন্যু রক’। সেসব গান জেন–জি শ্রোতারা পছন্দও করছেন। ধারাটা আসলে কী?
সুমন: ‘বাংলা ন্যু রক’-এর লিরিক অর্থহীনের লিরিকের মতোই। তবে মিউজিকের স্ট্রাকচারটা একটু আলাদা। গিটার, কি–বোর্ডের পাশাপাশি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র থাকবে। এই অ্যালবামে সেতার, তবলাও বাজানো হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে একটা ‘জিনিস’ হয়েছে, যেটা আমার কয়েকজন বন্ধুকে শুনিয়েছি।
গ্র্যামিজয়ী মিউজিশিয়ানরা বলেছে, আমরা এর জনরাটা ধরতে পারছি না। জিনিসটা দারুণ হয়েছে। আমরা এটাকে ‘বাংলা ন্যু রক’ বলছি।
হালের জেন–জি শ্রোতাদের বোঝাপড়াটা অনেক ব্যান্ড ধরতে পারছে না, ফলে অনেক পুরোনো ও নামী ব্যান্ড হালের শ্রোতাদের কাছে সেকেলে হয়ে গেছে। আপনারা জেন–জি শ্রোতাদের বোঝাপড়াটা কীভাবে ধরছেন?
সুমন: আমি সব সময় নতুন জিনিস পছন্দ করি। ‘ত্রিমাত্রিক’ ও ‘বিবর্তন’-এর পর থেকেই অর্থহীন পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছে। প্রতিটি অ্যালবামেই অর্থহীন ধীরে ধীরে বদলেছে। ‘ফিনিক্সের ডায়েরি ২’ অ্যালবামে আমরা আরেক রকম হতে যাচ্ছি। আমরা আজকেই ফল পাওয়ার জন্য বসে থাকি না। একটা সময়ে এসে গানগুলো মানুষ শুনবে।
আমাদের ফ্যানদের একটা ঘটনা বলি, এক কনসার্টে এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। দুজনই অর্থহীনের ফ্যান। বাপ ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’ শুনে লাফাচ্ছে, ছেলে ‘বিদ্রোহী’ শুনে লাফাচ্ছে। এটাতেই বোঝা যায়, আমরা চেঞ্জ না হলে আজকে ছেলেটা আসত না, শুধু বাপই আসত।
এক কনসার্টে এক ভদ্রলোক তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে। দুজনই অর্থহীনের ফ্যান। বাপ ‘অদ্ভুত সেই ছেলেটি’ শুনে লাফাচ্ছে, ছেলে ‘বিদ্রোহী’ শুনে লাফাচ্ছে।সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন, অর্থহীন
অর্থহীনের পরবর্তী অ্যালবামেও ‘বাংলা ন্যু রক’ ধারার গান থাকবে?
সুমন: অবশ্যই। এই জনরাটাকে স্টাবলিশ করব। স্পটিফাইয়ে একটা প্লে–লিস্ট আছে, ‘বাংলা রক’; সেটা আগে ছিল না। এটা আমরা স্পটিফাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জিনিসটাকে স্টাবলিশ করেছি। এখন স্পটিফাই বলতেছে, ‘বাংলা ন্যু রক’ বা ‘বাংলা রক’ নামের কোনো জনরা বানাতে চাইলে বেশ কিছু গান লাগবে। আগে বাংলা রককে স্টাবলিশ করব, এরপর বাংলা ন্যু রক।
স্পটিফাইয়ের অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যখন জিজ্ঞাসা করবে, তুমি বাংলা রক পছন্দ করো? সেটা আমাদের জন্য কত বড় একটা গর্বের ব্যাপার হবে, ভাবতে পারছেন? আমরা এটার পেছনে ছুটতেছি। আমরা আর অর্থহীনের পেছনে ছুটছি না। আমরা প্রচুর ফেম কামিয়েছি। প্রচুর টাকা কামিয়েছি। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা বোনাস।
আমি যে এখন বেঁচে আছি, সেটাই তো বোনাস। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তার বলেছিল, ২০১১ সালে আমি মরে যাব। এখনো বেঁচে আছি, আমি বোনাস লাইফ কাটাচ্ছি।
২০১০ সালে আপনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। রিপোর্ট পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন, পরে কীভাবে প্রাণশক্তি পেলেন?
সুমন: ২০১০ সালে ক্যানসারের কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে যাই, সাত থেকে আট দিন দরজা–জানালা বন্ধ করে বসে ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, আমি কীভাবে হ্যান্ডেল করব। তখন একা থাকতাম। পরিবারকে জানাইনি, ছেলেমেয়েরা জানলে পাগল হয়ে যাবে। ডাক্তার আমাকে আট থেকে চৌদ্দ মাস সময় দিয়েছিল। আমার এক বন্ধু আমেরিকায় ছিল, ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। ওকে ফোনে বিষয়টা জানালাম। ও ছয় দিনের মাথায় বাংলাদেশে চলে আসে। ছয় দিন আমার সঙ্গে ছিল। এর মধ্যে বাচ্চা থেকে ম্যাচিউর মানুষ বানিয়ে ফেলেছে। তখন মনে হয়েছিল, আমার ক্যানসার নিয়ে কোনো ভয় নেই, মরলে মরব। সে আমাকে এই পরিমাণ সাহস দিয়েছে।
ছয় দিন পর আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছিল। যাওয়ার আগে খেয়াল করলাম, ওকে বিধ্বস্ত লাগছিল। আমি বললাম, ‘তোমার কিছু হয়েছে?’ আমাকে চমকে দিয়ে ও মাথায় টান দিয়ে চুলটা খুলে ফেলল। ও বলল, তাঁরও ক্যানসার। ডাক্তার তাকে দুই থেকে তিন মাসের সময় দিয়েছে। আমি তখন আর নরমাল থাকতে পারিনি। ও আমেরিকা চলে যাওয়ার পাঁচ মাস পর মারা গেছে। যেখানে আট থেকে চৌদ্দ মাসের মধ্যে আমার মরে যাওয়ার কথা ছিল। চৌদ্দ বছর পর বসে এখানে আড্ডা দিচ্ছি, সে পাঁচ মাস পরই মারা গেছে। ও আমাকে যেভাবে শিখায়ে দিয়ে গেছে, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, ক্যানসার জীবনে আমাকে আটকাতে পারবে না।
‘নিকৃষ্ট ৩’ গানে যত গালাগালি আছে, সবাই আমাকে বলে, ‘কারে নিয়ে লিখছ?’ গানটা কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে লিখিনি, ক্যানসারের বিরুদ্ধে লিখেছি। আমি ক্যানসারকে ঘৃণা করি। ক্যানসার আমাকে ভালোবাসে, সে আসতেই থাকে। ক্যানসার হলে আমি বলি, ক্যানসারই তো। জ্বর তো আর না, জ্বর হলে সমস্যা। মরে গেলে তো মরেই গেলাম, কিন্তু মরি নাই। আমার জিদ অনেক বেশি বেশি।
কী রকম?
সুমন: মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আমার সঙ্গে অনেক অবিচার করা হয়েছে। আমি চুপচাপ থেকেছি। আমার জিদ অনেক বেশি। যে কারণে আরও মিউজিক করে, অর্থহীনকে আরও ওপরে তুলে দেখিয়ে দেব। আমি যে আজকে এত শুকনা, এর পেছনে কারণ আছে। আমি সারা জীবন মোটা ছিলাম, একসময় আমার ওজন ১৭৪ কেজি ছিল; এখন আমার ওজন ৬০ কেজি। আরও শুকাতে চাই। আমি আন্ডারওয়েট হতে চাই।
আন্ডারওয়েট হলে ছবি তুলে, ভিডিও করে রেখে এখনকার অবস্থায় আসব। কারণ, আমি বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছি। আমি সেই লোকদের দেখায়ে দিতে চাই। আমার জিদ অনেক বেশি। যখন যেটা আমি ধরি, সেটা শেষ করে তারপর ছাড়ি।
সর্বশেষ ৭ মাসে আমার শরীরে ১১টা সার্জারি হয়েছে। আমার দুই চোখই ফেলে দেওয়া হয়েছে, আর্টিফিশিয়াল চোখ লাগানো হয়েছে। আমার পায়ের টেনডন ছিঁড়ে গেছে, অপারেশন করা হয়েছে। স্ক্রিনে, ব্রেনে সার্জারি করা হয়েছে। আমার স্পাইনে ১৮টা স্ক্রু বসানো। এখন পর্যন্ত ভালো আছি। সার্জারির সঙ্গে শুকানোর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার স্পাইনের কারণে চিকিৎসক বলেছেন, আমাকে শুকাইতে হবে। তবে ব্যয়াম করা যাবে না। কারণ, স্পাইন ভেঙে যেতে পারে। আমাকে না খেয়ে শুকাতে হবে। পুষ্টিবিদের পরামর্শে তিন বছরে এতখানি শুকাইছি। শুকানোটা পুরোপুরি ইন্টেনশনাল। এখন যা শুকনা দেখতেছেন, সামনে আরও শুকনা দেখবেন। তারপর এখনকার অবস্থায় আসব।
(সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব প্রকাশিত হবে আগামীকাল।)