কদিন থেকে ঘুমাতে পারছি না। নানা এলোমেলো স্মৃতি, চিন্তা মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীল করে রাখছে।
একসময় আমার বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করার শখ ছিল। একবার আমি ও কাদেরি কিবরিয়া (রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী) ভোলার এক দুর্গম জায়গায় রাজহাঁস শিকার করতে গেলাম। দুটো রাজহাঁস দেখতে পেলাম। গুলি করলাম। একটি পড়ে গেল, অপরটি দাঁড়িয়ে রইল। পাখিটাকে আনতে এগিয়ে গেলাম কিন্তু তার সঙ্গী পাখিটি দুই ডানা বিস্তার করে আগলে রাখল। কিবরিয়া বন্দুক তাক করল মারার জন্য। তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিবৃত্ত করলাম। এমন ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সাহস মনুষ্য সমাজেও বিরল। এ দৃশ্য আমি আজও ভুলিনি। সেদিন থেকে আমিও শিকার করা ছেড়ে দিয়েছি।
কদিন থেকে সেই দৃশ্য এবং সেই সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অকুতোভয় তরুণ শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি এসে ভিড় করে। হৃদয় কেঁদে ওঠে, ঘুম চলে যায়। মাথার ভেতর প্রশ্ন এসে পীড়া দেয়, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও এই দৃশ্য দেখতে হলো? কী অপরাধে এতগুলো তরুণ প্রাণকে পিতা-মাতার বুক শূন্য করে, অকালে ঝরে যেতে হলো। আমার দীর্ঘ জীবনে একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এমন মৃত্যুর মিছিল তো দেখিনি। এটা তো আমেরিকার গৃহযুদ্ধও নয় বা ফরাসি বিপ্লব নয়।
একটি হিন্দি গানের কয়টি চরণ মনে পড়ল, ‘এটা কী হলো, কী করে হলো, কেন হলো, যা হবার হয়েছে, যেতে দাও...।’ না—যা হবার হয়েছে, যেতে দাও বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আমাদেরকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। নিজেদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সন্দেহ নেই দেশের প্রতিটি সংবেদনশীল মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সন্তান হারানো প্রত্যেক পিতা–মাতার প্রতিটি অশ্রুফোঁটার মূল্য দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ, সমাজের সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাসের প্রতিফলনই পারে এই মূল্য পরিশোধ করতে।