গতকাল শনিবার রাতে হঠাৎ করে খবর পাওয়া যায়, নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোর আর নেই। রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পাশে ভাড়া বাসা থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জনপ্রিয় এই শিল্পীর মৃত্যুর খবরে সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। মনি কিশোরের মৃত্যুর কারণ এখন জানা যায়নি। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রামপুরা থানার পুলিশ কর্মকর্তা।
গতকাল শনিবার রাতে মনি কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করেছে রামপুরা থানার পুলিশ। রামপুরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ভবনের মালিক ভাড়ার জন্য মনি কিশোরের খোঁজ করেন। সকাল থেকে তিনি (ভবনের মালিক) কণ্ঠশিল্পী মনি কিশোরের ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তখনো ফোন চালু ছিল। রাতে আবার চেষ্টা করে ফোন বন্ধ পাওয়ায় সরাসরি ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখতে পান, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পাশাপাশি সেখান থেকে বিকট গন্ধ পাওয়ায় তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে কল দিয়ে পরিস্থিতি জানান। ৯৯৯–এ ফোন পেয়ে রামপুরা থানার পুলিশ সেখানে ছুটে যায়। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, চার থেকে পাঁচ দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, অসুস্থতার কারণে মনি কিশোর মারা যেতে পারেন। তিনি চিকিৎসা করাচ্ছিলেন বলেও পুলিশের ধারণা। বাসায় সিটি স্ক্যান, এমআরআই রিপোর্টসহ কিছু মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়া গেছে। পুলিশ কর্মকর্তা খান আবদুর রহমান জানান, মনি কিশোরের এক ভাই যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি এলে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
কথা হয় শিল্পীর বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অশোক কুমার মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে জানান, মনি কিশোর নানা রোগে ভুগছিলেন। এর মধ্যে হার্টের সমস্যা যেমন ছিল, তেমনি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের সমস্যাও। কয়েক মাস ধরে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
অশোক কুমার এ–ও জানান, পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সাত সন্তানের মধ্যে মনি কিশোর চতুর্থ সন্তান। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাই মারা গেছেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি বিয়ে করেন। দেড় যুগ আগে মনি কিশোরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। এর পর থেকেই মনি কিশোর একা থাকতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। মনি কিশোর নামে সংগীতাঙ্গনে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম মনি মণ্ডল। কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন বলে নামের সঙ্গে ‘কিশোর’ জুড়ে নিয়েছিলেন। এ তথ্য তিনি নিজেই প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। নড়াইল জেলার লক্ষ্মীপুরে ১৯৬১ সালের ৯ জানুয়ারি জন্ম মনি কিশোরের। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তাঁর।
ফিরতে চেয়েছিলেন গানে
মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায়ও তেমন গাননি। মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তাঁরই সুর করা ও লেখা। মাঝে দীর্ঘদিন নতুন গান প্রকাশ থেকে দূরে ছিলেন এই গায়ক। চলতি বছর এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি আবারও গান করছেন। জানিয়েছিলেন, পুরোনো গানগুলো ইউটিউবে দিচ্ছেন পর্যায়ক্রমে। জনপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, এ প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি শুনেছেন।
ইউটিউবে প্রচুর ভিউ। স্টেজে গেয়ে থাকেন তরুণেরা। কিন্তু গানের মূল গায়ককে তাঁরা চেনেন না। গানটির সুরকার ও গীতিকার কে, তা জানেন না। এই রকম জায়গা থেকে ভেবেছেন, এ প্রজন্মের কাছেও গানটি পরিচিত হোক। তাঁদের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আলাদা করে দেড় শ গান তৈরি করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গানগুলো আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে চাই না। কিছু গান মৃত্যুর পরও প্রকাশ পাবে।’ জীবদ্দশায় মনি কিশোর তাঁর এই গানগুলো প্রকাশের আগেই চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। এই শিল্পী যেমনটি চেয়েছিলেন, হয়তোবা সেই ইচ্ছা পূরণ করবে তাঁর পরিবার। তাঁর তৈরি হওয়া গানগুলো হয়তোবা সামনে প্রকাশিত হবে।