এ দেশে পপ সংগীতকে তুমুল জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টায় যিনি অগ্রণী, তিনি আজম খান। এ কারণেই তাঁর নামের আগে ব্যবহৃত হয় ‘পপসম্রাট’। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গান তরুণ তো বটেই, সব ধরনের শ্রোতার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। সেই তালিকা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে পাঁচটি গান। আজম খান এসব গান সৃষ্টির পেছনের গল্প বলে গেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া গীতিকার কবির বকুলের কাছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করে গানের গল্পগুলো আবার শুনি। দ্বিতীয় পর্বে রইল ‘আলাল–দুলাল’ গানটির গল্প।
এটা আড্ডারই গান। এই গান হলো আমাদের বন্ধুদের সম্মিলিত প্রয়াস। কবি জসীমউদ্দীনের বাড়ির বাগানের দেবদারুগাছের তলায় প্রতিদিনই বন্ধুরা আড্ডা দিতাম। গিটার নিয়ে টুংটাং করতাম। আমাদের দুই বন্ধু শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর; আপন দুই ভাই ওরা। ওদের ‘আলাল-দুলাল’ বলে খেপাত আমাদের আরেক বন্ধু আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। ওদের খেপানোর নানা রকম ভাষা থেকেই পরে ‘আলাল-দুলাল’ গানের সৃষ্টি। আমরা মজা করে গাইতাম, শুনে লজ্জায় শাহজাহান আর জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকত। প্রথম প্রথম গাইতাম, ‘আলাল দুলাল, তাদের বাবা হাজি চান, প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। আমাদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। আমার মেজ ভাই আলম খান (সংগীত পরিচালক) গানটি শুনে বললেন, ‘ওই পুলে’র জায়গায় ‘চানখাঁর পুল’ শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে। তা–ই করলাম। একদিন চিন্তা করলাম, গান যখন গাই, এটা গাইছি না কেন। বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের (সম্ভবত ‘চারুপাঠ’) জন্য গানটা রেকর্ড করলাম; কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সেই গানও দেখি রাতারাতি হিট।
মজার বিষয় হলো, পুরান ঢাকার চানখাঁর পুলে সত্যি সত্যি ‘হাজি চান’ নামের এক মুরব্বি ছিলেন।
গান শুনে তিনি তো বেজায় খুশি। মনে করলেন, গানটি তাঁকে নিয়েই লেখা হয়েছে। তিনি আমাদের এক বন্ধুকে পেয়ে বললেন, ‘আজম খান তো “আলাল দুলাল” গানটা জব্বর গাইছে। গানের ম্যাজিকটাভি (মিউজিক) ফাটাফাটি হইছে। ওরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহো। আমার দাওয়াত।’ তারপর আমরা বন্ধুরা মিলে একদিন তাঁর বাড়িতে যাই। গানবাজনা করি।কিছুদিন আগে অমিতাভ রেজা ফোন করে বলল, ‘আপনার “আলাল দুলাল” গানটা একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে ব্যবহার করতে চাই।’ আমি বললাম, তুমি তো ভালোই বানাও। ঠিক আছে, ব্যবহার করো।
অমিভাভ বলল, ‘একটা সমস্যা, গানটা নতুন করে কাকে দিয়ে গাওয়াই!’ আমি বললাম, নতুন কাউকে নিলে সে কেমন গাইবে, তার চেয়ে বরং আমিই গেয়ে দিই। শুনে অমিতাভ বলল, ‘আপনি গাইলে তো ভালোই হয়।’ বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য গানটা আবার গাইলাম।
পুরো গানো এখানে রইল
আলাল ও দুলাল
আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখাঁর পুলে প্যাডেল মেরে পৌছে বাড়ি
আলাল ও দুলাল
আলাল যদি ডাইনে যায়
দুলাল যায় বাঁয়ে
তাদের বাবা সারা দিন খুঁজে খুঁজে মরে।।
আলাল কই
দুলাল কই
নাইরে নাইরে নাইরে নাই
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখাঁর পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি
আলাল ও দুলাল
আলাল যদি ডালে থাকে
দুলাল থাকে চালে
পাড়াটারে জ্বালায় তারা সারাটা দিন ধরে
আলাল কই
দুলাল কই
নাইরে নাইরে নাইরে নাই
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখাঁর পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল; আলাল ও দুলাল……
(দ্রষ্টব্য: ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে লেখাটি প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল)