পরিবারের সবাই কমবেশি গানবাজনা করতেন। মা নিরুপমা মন্ডলের সংগীতশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় গানের চর্চা। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার অন্য সন্তানেরা পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী হলেও অনিল কুমার মন্ডলের ইচ্ছা ছিল শিল্পী হবেন। পড়াশোনার ফাঁকে এদিকটায় ছিল তাঁর তীব্র আগ্রহ। বাবার চাকরিসূত্রে যশোর, ফরিদপুর, নড়াইল হয়ে একটা সময় গানের টানে ঢাকায় বড় বোনের বাসায় এসে থিতু হন। এই বোনের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে মনি কিশোর নামের কাউকে চিনত না দেশের মানুষ। মন্ডল পরিবারের একজন হয়েই থেকে যেতেন। কিন্তু বড় বোনের উৎসাহে তিনি গান নিয়মিত করেন। আর একটা সময় গীতিকার-সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের মাধ্যমে বিটিভি তাঁর প্রতিভাকে বিকাশের বড় সুযোগ করে দেয়।
সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিটিভিতে গাইলেন ‘কী ছিলে আমার’, এই গান প্রচারের পর দেশের আনাচকানাচ থেকে অনেক চিঠি পেয়েছেন।
মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায় তেমন গাননি। মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তাঁরই সুর করা ও লেখা। মাঝে দীর্ঘদিন নতুন গান প্রকাশ থেকে দূরে ছিলেন এই গায়ক।
চলতি বছর এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি আবারও গান করছেন। জানিয়েছিলেন, পুরোনো গানগুলো ইউটিউবে দিচ্ছেন পর্যায়ক্রমে। জনপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, এ প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি শুনেছেন।
ইউটিউবে প্রচুর ভিউ। স্টেজে গেয়ে থাকেন তরুণেরা; কিন্তু গানের মূল গায়ককে তাঁরা চেনেন না। গানটির সুরকার ও গীতিকার কে, তা জানেন না। এ রকম জায়গা থেকে ভেবেছেন, এ প্রজন্মের কাছেও গানটি পরিচিত হোক। তাঁদের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আলাদা করে দেড় শ গান তৈরি করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘গানগুলো আমার জীবদ্দশায় প্রকাশ করতে চাই না। কিছু গান মৃত্যুর পরও প্রকাশ পাবে।’ জীবদ্দশায় মনি কিশোর তাঁর এই গানগুলো প্রকাশের আগেই চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। এই শিল্পী যেমনটি চেয়েছিলেন, হয়তো সেই ইচ্ছা পূরণ করবে তাঁর পরিবার। তাঁর তৈরি হওয়া গানগুলো হয়তো সামনে প্রকাশিত হবে।
শিল্পী হওয়ার তাড়নায় ঢাকায় এসে উঠেছিলেন বড় বোনের বাসায়। দুলাভাই নাকি গান গাওয়ার বিষয়টি পছন্দ করতেন না। তাই দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতেন।
সেই ঘটনার বর্ণনা মনি কিশোর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ঢাকায় বোনের বাসায় পাম্পের বালিশ ফুলিয়ে ফুলিয়ে ঘুমাতাম। বড় বোন মায়ের মতো ছিলেন। তাঁর কারণে আমার মনি কিশোর হয়ে ওঠা।
আরেকটা কথা, দুলাভাই বাসায় থাকা অবস্থায় রুমে ঢুকতাম না, বিরক্তি বোধ করবেন ভেবে। তিনি যখন বাসায় থাকতেন, আমি বাসার সানসেটে ঘুমাতাম। এরপর বাসা থেকে চলে গেলে ঘরে এসে ঘুমাতাম। ওর বাসায় সেই আশ্রয়টুকু না পেলে মনি কিশোর হতে পারতাম না। হয়তো সেই মন্ডল বংশে ফিরে যাওয়া লাগত।’
ঢাকায় একদিন দেখা হয় গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মিল্টন খন্দকারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি মনি কিশোরকে একদিন বিটিভিতে নিয়ে যান, দেখা করিয়ে দেন ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম গান গাওয়ার ঘটনার কথা গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এভাবে বলেছিলেন মনি কিশোর, ‘মিল্টন খন্দকার আমাকে বললেন, “আপনাকে ফিরোজ মাহমুদ সাহেবের কাছে নিয়ে যাব।” জানতে চাইলাম, উনি কে? বললেন, “গেলেই বুঝতে পারবেন।” একদিন গেলাম। ক্যাসেটে গান রেকর্ড করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন সেখানে সাবিনা (ইয়াসমীন) আপা, নজরুল ইসলাম বাবু ভাই, আলীমুজ্জামান দুলু ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। বিটিভির নির্বাহী প্রযোজক ফিরোজ মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে মিল্টন খন্দকার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এভাবে, “আমি তো সংগীতের মানুষ, যারা সংগীত প্রবাহ ও গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গান গায়, তাদের চেয়ে এ (মনি কিশোর) অনেক ভালো গাইবে। না গাইলে তখন আমাকে বইলেন।”
এরপর গান শুনলেন। ফিরোজ ভাই যখন গানটা শুনছিলেন, হঠাৎ বাবু ভাইও চুপ হয়ে গেলেন। একটা সময় পুরো ঘর চুপচাপ হয়ে গেছে। সেদিনই তিনি বিটিভির গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে গাইবার সুযোগ করে দেন।’
প্রথমবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে গাইবেন। তাই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন মনি কিশোর। টেলিভিশন ভবন থেকে বের হয়ে জামাকাপড় কিনতে ছুটে যান।
সেই ঘটনার কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘গুলিস্তানে গিয়ে একটা শার্ট কিনলাম, ৬০ টাকা দিয়ে। আরেকটা কালো রঙের গেঞ্জি কিনলাম ২০ টাকা দিয়ে। পরদিন বিটিভিতে গেলাম। আলম আরা মিনু, হাসান চৌধুরী, ডলি সায়ন্তনীও ছিলেন। একটা সময় আমার গান রেকর্ডিংয়ের পালা আসে। রেকর্ডিং শেষে আমি দেড় হাজার পোস্ট কার্ড কিনেছিলাম। খালি লিখি আর পাঠাই। বন্ধু, পরিচিতজন সবাইকে পাঠিয়েছি। শুধু লিখেছি, আমার গাওয়া গানটা অমুক দিন যাবে, দেখতে হবে কিন্তু। রাত–দিন খালি চিঠি লিখি। শুধু যশোরে ৫০০ থেকে ৭০০ পোস্ট কার্ড পাঠিয়েছিলাম। এর বাইরে ফরিদপুরসহ যেখানে যেখানে থেকেছি।’
গানের তালিম নেওয়া হয়নি কোনো দিন মনি কিশোরের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হারমোনিয়ামের হা–ও কিন্তু জানি না। আর সারেগামারও সা–ও জানি না। বলতে পারেন, আমি একটা ফটোকপি শিল্পী। আমাকে যে সংগীত পরিচালক যা শিখিয়ে দিতেন, আমি তা–ই গেয়ে দিতাম। কাচের ওপাশ থেকে যা শোনাতেন, তাই গেয়ে দিতাম। আমার কান দুটোই ছিল সম্বল।
এদিকে গান প্রচারের আগে শুনলাম, কে বা কারা ওই সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন, অডিশন ছাড়া একজন শিল্পী আছে গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে, যাকে টাকার বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই। নিয়মিত শিল্পীদের বাদ দিয়ে এই শিল্পীকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে! এরপর তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীকে ফিরোজ মাহমুদ ভাই পুরো অনুষ্ঠানটা শুনিয়েছেন।
শোনার পর তিনি বলেছিলেন, এই শিল্পীর অডিশনের কোনো দরকার নেই। রেডিও এবং টেলিভিশনের মূল কাজই হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিভা খুঁজে এনে প্রতিষ্ঠিত করা। পরীক্ষা দিয়ে শিল্পী হওয়ার সুযোগ এখানে নেই। নির্ধারিত তারিখে আমার গাওয়া “কী ছিলে আমার” গানটা প্রচার হলো না। এই ঘটনার পর, আমি দুই দিন কিছু খাইনি। অনেক কান্না করেছি। চিন্তা করলাম, শিল্পীই আর হব না। এরপর একদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়েছি, তখন মিল্টন বললেন, “তোর গানটা বোধ হয় পরশু দিন যাবে।” আমি তখন বলেছি, গেলে যাক। আমি কাউকে কোনো চিঠিও লিখব না। কিচ্ছু করব না। অনুষ্ঠানও দেখব না। এবং কিছুই করিওনি, টেলিভিশনটা খুলি নাই। ভেবেছি, আবার হয়তো প্রতারণা হবে। কিন্তু ঠিকই গানটা প্রচারিত হয়। শুধু টেলিভিশনেই এই গান প্রচারের চিঠি আসছে ৫ থেকে ১০ হাজারের মতো। আর আমার ঠিকানায় বলা যায় প্রতিদিন বস্তায় বস্তায় আসত।’
নব্বইয়ের দশক থেকেই গান গেয়ে শ্রোতার মন মাতিয়েছেন মনি কিশোর। সেই কবে গেয়েছিলেন ‘কী ছিলে আমার, বলো না তুমি’; তা আজও অনেক সংগীতপ্রেমী গেয়ে ওঠেন আপন মনে। সেই গানের স্রষ্টা মনি কিশোর দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। অনেকটা অভিমান থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। শেষ দিকে তো এমনও হয়েছে, কেউ যাতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে, নিজের ব্যবহৃত পুরোনো মুঠোফোন নম্বর বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’ ছাড়াও ছিল ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তাঁরই সুর করা ও লেখা।
শিল্পী হিসেবে মনি কিশোরের আলাদা একটা গণ্ডি ছিল বলে মনে করতেন তিনি। সে কথাটা এভাবে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেকের একটা আলাদা গণ্ডি আছে। আমার যেমন মেয়ে ভক্তরা বেশি, বিশেষ করে গার্মেন্টসের। আমার কিন্তু ড্রয়িংরুমের, মানে গুলশান-বনানী ও ধানমন্ডির শ্রোতা নেই। আমার শ্রোতা রিকশাওয়ালা, বিশেষ করে গার্মেন্টসের। এই রিকশাওয়ালা ও গার্মেন্টসের মানুষেরা আমাকে মনি মন্ডল থেকে মনি কিশোর করেছে। ওরাই আমার জীবনের সব।’
রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পাশে একটি ভাড়া বাসায় একা থাকতেন। শনিবার রাতে চিরদিনের জন্য তাঁর শেষ পৃথিবী ভ্রমণের খবর পাওয়া যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেন।
এ দেশে মনি কিশোর আর জন্মাবে না বলেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি মনি কিশোর আর গায়ক মনি কিশোরের আকাশ–পাতাল তফাত। কোনো মিল নেই। চরিত্রের মিল নেই, কথাবার্তার মিল নেই, চালচলনের মিল নেই। মানুষ মনি কিশোর যখন মাইক্রোফোন হাতে নেয়, তখন সে অন্য এক মনি কিশোর হয়ে ওঠে। অসাধারণ গায় সেই মনি কিশোর। আমি শ্রোতা হিসেবে শিল্পী মনি কিশোরের গান দিনের পর দিন, রাতের পর রাত শুনেছি। শ্রোতা হিসেবে বলছি, শিল্পী মনি কিশোর জন্মাবে না আর।’
পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সাত সন্তানের মধ্যে মনি কিশোর চতুর্থ সন্তান। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাই মারা গেছেন। দেড় যুগ আগে মনি কিশোরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে একা থাকতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। নড়াইল জেলার লক্ষ্মীপুরে মামাবাড়িতে ১৯৬১ সালের ৯ জানুয়ারি জন্ম মনি কিশোরের। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় থাকা হয়েছে তাঁর।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের ‘কী ছিলে আমার’ শিরোনামের একটি গান মনি কিশোরকে প্রতিষ্ঠিত ও ব্যাপক পরিচিত করে দেয় সংগীতাঙ্গনে। একে একে ৩০টির বেশি একক অ্যালবাম করে ফেলেন। তারপর একসময় অডিও জগৎ নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকল। একটা সময় মনি কিশোরের আর নিয়মিত দেখা মেলেনি।