কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন
কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন

দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে যা বললেন বেবী নাজনীন

কয়েক বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরলেন সংগীতশিল্পী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বেবী নাজনীন। গতকাল রোববার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন তিনি। দেশে ফিরেই এই সংগীতশিল্পী ও রাজনীতিবিদ জানালেন, বিমান থেকে নেমেই বুকভরে নিশ্বাস নিয়েছি। যে নিশ্বাসটা অতি আদরের, গভীর ভালোবাসার। এটা বহুদিন পাইনি। এই না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কী, সেটা আজকে পাওয়ার পরে আরও বেশি বুঝতে পারছি।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিগত সরকারের আমলে পেশাগত কর্মকাণ্ড প্রায় থেমে যায় বেবী নাজনীনের। পরবর্তী সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। গতকাল দেশে ফিরেছেন বেবী নাজনীন বলেন, ‘শিল্পীরা সব সময় দলমতের ঊর্ধ্বে, তাঁদের কখনোই কোনো বাধানিষেধের মধ্যে রাখা যাবে না।’

মাত্র সাত বছর বয়স থেকে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু বেবী নাজনীনের

ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান রাজনৈতিক নেতা–কর্মী এবং ভক্ত–শুভানুধ্যায়ীরা। নামার পরই বেবী নাজনীন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নিহত সব শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
সাত বছর বয়স থেকে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু বেবী নাজনীনের। সেই যে শুরু, চলেছে টানা ২০০৮ পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্টেজ শো কমতে থাকে। এই কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো স্টেজ শোতে দেখা যায়নি এই শিল্পীকে। দেশের মঞ্চে গাইতে না পারলেও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়ে চলছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, ‘বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণেই আমার গানের কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত বাধা এসেছে।’

রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কারণেই সংগীতর্চচা চালিয়ে যেতে পারেননি বলেও জানিয়েছিলেন বেবী নাজনীন। তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করাটা সবার স্বাধীনতা, আমিও তা–ই করেছি। অথচ এই রাজনীতি করার কারণে একের পর এক আমার কনসার্ট বাতিল হয়েছে। এমনকি টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠান থেকেও অজ্ঞাত কারণে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রাজনীতির কারণে আমাকে কোণঠাসা করা হয়েছে। একজন জাতীয় শিল্পী হিসেবে আমি কিন্তু নানা সময়ে দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছি। গানের মাধ্যমে আমি আমার ইন্ডাস্ট্রিকে এনহেন্স করেছি। বিএনপির রাজনীতির কারণে অনেক বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকা বন্ধ। কিছুই বলি না, মনে মনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া কিছুই তো করার নেই।’

বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে বেবী নাজনীনসহ অনেক শিল্পী ছিলেন কালো তালিকাভুক্ত। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্পীদের জন্য এটা দুঃখজনক। কালো রাত্রি, কালো দিবস বা কালো ইতিহাস বলা যায়। শিল্পীরা দেশের মুকুট। তাঁরা সব সময় সম্মানের। সংস্কৃতির মাধ্যমে শিল্পীরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। শিল্পীরা সব সময় দলমতের ঊর্ধ্বে। বিশেষ কোনো দলের সমর্থক বলে তাঁদের এড়িয়ে চলতে হবে—এমনটা আমি চাই না।’

ভবিষ্যতে আবারও কালো তালিকা তৈরি হবে কি না, এমন প্রসঙ্গ উঠতেই বেবী নাজনীন বলেন, ‘শিল্পীদের কোনো বাউন্ডারি থাকতে নেই। শিল্পীদের কখনোই কোনো বাধানিষেধের মধ্যে রাখা যাবে না। আমি সব সময় এই শব্দের বিরুদ্ধে। সংগীত একটা পরিচ্ছন্ন বিষয়। শিল্পীরা যখন একে বহন করবেন, তখন নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে হবে। কালো তালিকা শব্দটাই তো খারাপ। আমি কেন শব্দটি লালন করব। বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে, এখানে কালো তালিকা শব্দটি যেন আর না আসে। আমি শিল্পী, আমি প্রাণ খুলে গাইব। আমি কেন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ব, কেন আমাকে নিয়ে রাজনীতি হবে। এসব নোংরামির কারণে শিল্পীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।’

দেশের বাইরে থাকলেও রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় বেবী নাজনীন। গত জুন মাসে বেবী নাজনীনকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়। বিমানবন্দরে তিনি জানান, এখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। ভবিষ্যতে দলীয় নির্দেশনা মেনেই কাজ করবেন। তবে গান নিয়েও পরিকল্পনা আছে তাঁর। বেবী নাজনীন বলেন, ‘অনেকগুলো নতুন গান প্রস্তুত আছে। শিগগিরই সেগুলো রেকর্ড হবে। মাত্রই এলাম, তাই একটু সময়ের প্রয়োজন। তবে আমি এখন কনসার্ট করব। সামনে থেকে আমার ভক্তদের দেখব। আমার ইচ্ছামতো তাঁদের সামনে গাইব।’

বেবী নাজনীনের গানের হাতেখড়ি বাবা মনসুর সরকারের কাছে। তারপর জীবনের দীর্ঘ চলার পথে সংগীতের নানা দীক্ষা এবং সাধনায় নিজেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। ১৯৮০ সালে প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এহতেশামের ‘লাগাম’ সিনেমার গানটির সুর ও সংগীত করেন আজাদ রহমান। ১৯৮৭ সালে মকসুদ জামিল মিন্টুর সংগীত পরিচালনায় প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’। এটিই তাঁর সংগীতজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারপর ‘নিঃশব্দ সুর’, ‘কাল সারা রাত’, ‘প্রেম করিলেও দায়’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না’ অ্যালবামগুলো আধুনিক গানে বেবী নাজনীনের অবস্থান শক্ত করে। ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনের রাত’, ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না তোমাকে দেখার পর’, ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল রে মরার কোকিলে’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘কই গেলা নিঠুর বন্ধু রে সারা বাংলা খুঁজি তোমারে’, ‘পুবালী বাতাসে’, ‘ও বন্ধু তুমি কই কই রে...’, এমন অনেক জনপ্রিয় গান আজও দেশের মানুষের মুখে ফেরে। তাঁর সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন’।