থেমে থেমে বৃষ্টি ছিল দুপুরে। মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছিল; সন্ধ্যায় বৃষ্টি না থামলেও ছিল ভ্যাপসা গরম। এমন পরিবেশে শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমি ও ছায়ানটে ভেসে বেড়ায় গানের সুর। শিল্পকলায় ছিল লালন, ছায়ানটে নজরুলের গান। চার দেয়ালের মিলনায়তন কিংবা উন্মুক্ত ময়দানে ছিল উল্লেখযোগ্য মানুষের উপস্থিতি। বাণী আর বিচিত্র সুরের অবগাহনে সিক্ত হয় শ্রোতার অন্তর।
সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে তিন দিনের ‘লালন স্মরণোৎসব’। এ উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল শুক্রবার। গতকাল দ্বিতীয় দিনে ছিল ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ শীর্ষক সাধু মেলা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা প্রজন্মের শিল্পীরা অংশ নেন এখানে। একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি বিভাগের পরিচালক মেহজাবীন রহমান। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করে মেহজাবীন রহমান বলেন, ‘লালন সাঁইজি বৈষম্যবিরোধী এবং মানবতার কথা বলে গেছেন।’ অনুষ্ঠানে আগত বাউল শিল্পীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর এই দিনে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার মতো করেই আমরা লালন উৎসব আয়োজন করতে চাই।’
এদিন ছিল মূলত গানের আয়োজন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সন্ধ্যা ছয়টায় একাডেমির নন্দনমঞ্চে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে মঞ্চে আসেন নবীন–প্রবীণ বাউলেরা। সমবেত কণ্ঠে তাঁরা পরিবেশন করেন ‘এসো হে দয়াল কান্ডারি’। এরপর ছিল একক পরিবেশনা। পরিবেশিত গানের মধ্যে ছিল ‘কী সন্ধানে যাই’, ‘এনেছে এক নবীন গোরা’, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’, ‘সাইর লীলা বুঝবি খ্যাপা’, ‘দাসের যোগ্য নাই চরণে’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘কোন নামে ডাকিলে তারে’, ‘খাচার ভিতর অচিন পাখি’।
শেষ দিকে সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা শুনিয়েছেন ‘মিলন হবে কত দিনে’। এক পাশে দর্শক, অন্য পাশে শিল্পীরা দলবেঁধে বসে ছিলেন। একে একে ফরিদপুরের পাগলা বাবলু, কুষ্টিয়ার টুনটুন ফকির, চন্দনা মজুমদার, চুয়াডাঙ্গার বাউল লতিফ শাহ্, ফরিদপুরের আরিফ বাউল, রাজবাড়ীর আনোয়ার শাহ্, মানিকগঞ্জের বিল্পব ফকিরসহ ২০ জনের বেশি শিল্পী গান শুনিয়েছেন এদিন।
সভাপতির বক্তব্যে একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, ‘লালনের শিক্ষাই হলো অহিংস বাহাস আর সাধনা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মূলমন্ত্র। লালনের গান হলো তত্ত্ব গান, যা প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত, সাধনার সঙ্গে যুক্ত। তত্ত্ব যা যেকোনো সাধনার মূল খোঁজার প্রক্রিয়া। লালনের বাণী অনুসারে জ্ঞান অন্বেষিত হয় শিল্পকলার মাধ্যমে, এ জন্য লালন সাঁইজি আমাদের প্রিয়। আমাদের রাষ্ট্র গঠনের নতুন পরিকল্পনায় তিনি পথ দেখাতে সক্ষম। জ্ঞানভিত্তিক আত্মজীবন কী করে, রাষ্ট্র ও সমাজের কেন্দ্রে স্থাপিত হয় শিল্পকর্মের মাধ্যমে উনি তা দেখিয়েছেন।’
এর আগে বৃহস্পতিবার উৎসবের উদ্বোধনীতে সভাপতির বক্তব্যে একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ দর্শকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক এক অভ্যুত্থান–উত্তর সময়ে লালন ফকির সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস নতুন কিছু তাৎপর্য বহন করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একরৈখিক জাতীয়তাবাদের ফ্যাসিবাদ থেকে ভাবগত মুক্তির বিভিন্ন চিহ্ন আমরা লালন থেকে পেতে পারি। জাতিভেদ পন্থার বিপরীতে লালন সাঁইজির সাধনার উপায় ছিল শিল্পকলা, শ্রেণিকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে আমাদের নতুন রাজনীতি বন্দোবস্তের দার্শনিক ভিত্তি দিতে সক্ষম লালন সাঁইজি।’
শিল্পকলা যেন সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রীয় জায়গায় মূল ভূমিকা পালন করতে পারে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এগিয়ে যেতে পারে, তা উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন, জাতীয় বাজেটের তিন ভাগ যেন সংস্কৃতি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আজ সমাপনী: তিন দিনের উৎসবের আজ শেষ দিন। শনিবার সমাপনী দিনে বিকেল চারটায় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে প্রথম পর্বে ‘জাতিসত্তার প্রশ্ন এবং বাউল-ফকির পরিবেশনার রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক আ-আল মামুন। আলোচনা করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম; লেখক ও সাংবাদিক এবং পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ; নাট্যকার, লেখক ও গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শাহমান মৈশান।
দ্বিতীয় পর্বে সন্ধ্যা সাতটায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে দেশবরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে লালন স্মরণোৎসব ‘ধরো মানুষ রূপ নেহারে’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক আব্দুল হালিম। আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ এবং সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ।
ছায়ানটে শ্রোতার আসর
সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ছায়ানটে শুক্রবার সন্ধ্যায় হয়ে গেল শ্রোতার আসর। রাজধানীর ধানমন্ডির ছায়ানট ভবনের রমেশচন্দ্র দত্ত স্মৃতি মিলনকেন্দ্রে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আসর শুরু হয়। এদিনের আয়োজন সাজানো হয়েছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে। শিল্পী ঐশ্বর্য সমাদ্দারের কণ্ঠে রাগপ্রধান সংগীত ‘রিনিকি ঝিনিকি ঝিনিরিনি’ গানটি দিয়ে শুরু হয় আসর। এরপর শিল্পী শ্রোতাদের শোনালেন ‘শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না/ বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না।’
এরপর শুরু হয় শামিমা পারভিনের পরিবেশনা। সামন্ত কল্যাণ রাগে তিনি গেয়ে শোনান ‘সন্ধ্যা গোধূলি লগনে কে রাঙিয়া উঠিল কারে দেখে’ ত্রিতালের গানটি। এরপর পরিবেশন করেন দাদরা তালের গান ‘নয়নে নিদ নাহি, নিশিথ প্রহর জাগি।’ একে একে শোনা গেল, ‘আয় নেচে নেচে আয়’, ‘মম মায়াময় স্বপনে’সহ কয়েকটি গান।
শেষ পরিবেশনা ছিল শিল্পী সুমন মজুমদারের। তিনি পরিবেশন করেন দাদরা তালে ‘তোমার বাণী রে করিনি গ্রহণ’, টোড়ি রাগে গাইলেন ‘তোমার আকাশে উঠেছিনু চাঁদ, ডুবিয়া যাই এখন’–এর মতো কয়েকটি নজরুলসংগীত।
শ্রোতার আসরে শিল্পীদের সঙ্গে বাঁশিতে ছিলেন মামুনুর রশীদ, তবলায় গৌতম সরকার, কিবোর্ডে রবিঙ্গ চৌধুরী; মন্দিরা বাজিয়েছেন প্রদীপ কুমার রায়। ১৬টি সংগীত নিয়ে সাজানো হয়েছে এ শ্রোতার আসর।