জিমি হেনড্রিক্স, কার্ট কোবেইন, ব্রায়ান জোন্স, জ্যানিস জপলিন, অমর সিং চমকিলাসহ ৭০ জনের বেশি সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও কবি। তাঁদের মধ্যে সংগীতশিল্পীই বেশি; যাঁদের অপার সম্ভাবনা ছিল। তাঁদের বলা হয় ‘ক্লাব টোয়েন্টি সেভেন’-এর সদস্য। চাইলেই এই ক্লাবের সদস্য হওয়া যায় না, মৃত্যুর সুপারিশ লাগে। যে সুপারিশ পেয়েছিলেন আমাদের সংগীতজগতের ক্ষণজন্মা প্রতিভা হ্যাপি আখান্দ। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই শেষ হয় তাঁর জীবনযাত্রা। তিনিও ‘ক্লাব টোয়েন্টি সেভেন’–এর অলিখিত সদস্য। উইকিপিডিয়ার তথ্যে এই ক্লাবের তালিকায় তাঁর নাম নেই বটে; তবে ভক্তরা তাঁকে এই ক্লাবের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেন। আমাদের সংগীতজগতের তিনি দীর্ঘশ্বাস।
আজ ১২ অক্টোবর তাঁর জন্মদিন। চলে না গেলে গানে গানে ৬৩ পেরিয়ে ৬৪-তে পড়তেন। ১৯৬০ সালের ১২ অক্টোবর পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনের আখান্দ্ পরিবারে জন্মেছিলেন হ্যাপি। কেতাবি নাম জিয়া হাসান আখান্দ্। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন পারসি আর তাঁদের মূল পদবি ছিল আখান্দ্জাদে।
লেখার শুরুতেই পাঠকদের জন্য একটা প্রশ্ন। আনাচে-কানাচে সংগীতের আসরে বাংলাদেশের কোন গানটি সবচেয়ে বেশি গীত হয়? অনেক গানের কথাই হয়তো আসবে। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, যে গানের কথা বেশি আসবে, সেটি ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গাওয়া হয়ে আসছে এই গান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিকী থেকে শুরু করে পারিবারিক আয়োজন—বিয়ে, গায়েহলুদের আসর, বনভোজনসহ সব ধরনের আড়ম্বর-অনাড়ম্বর আয়োজনেই শোনা যায় ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’। এই ডিজিটাল যুগেও এতটুকু কমেনি এই গানের কদর। এই প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি জানেন, তবে হয়তো অনেকেই জানেন না গানটির মূল শিল্পীর নাম। ১৯৭৫ সালে ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ দিয়েই আলোচনায় আসেন হ্যাপি আখান্দ্।
প্রয়াত ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর মুখে হ্যাপি আখান্দের অনেক গল্প শোনা হয়েছে। একটা কথা প্রায়ই বলতেন তিনি, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে প্রথম ধাক্কা ছিল হ্যাপীর চলে যাওয়া, হ্যাপীর চলে যাওয়া সংগীতাঙ্গনের অনেক বড় ক্ষতি। তাঁর শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না।
তবু বাস্তবতা মেনে নিয়েই ফিডব্যাকের গানের কথাই বলতে হয়, শিল্পীর মৃত্যু নেই। হ্যাপি আখান্দের মৃত্যু নেই। আসলেই তো শিল্পীর মৃত্যু নেই। যেমন আজ বহুজনের স্মৃতিতে ফিরে এসেছেন হ্যাপি।
সব সময় দেখেছি, হ্যাপি গানের ভেতর ঢোকার উপায় পেয়ে যেতেন। এমনও সময় ছিল, ঘরে চার-পাঁচজন আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো সবার জন্য অ্যাকুয়াস্টিক গিটার নেই। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পকেট থেকে ম্যাচের কাঠি বের করে সেটা দিয়েই কিছু একটা বাজাতেন হ্যাপি।শাফিন আহমেদ
ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে অনেকেই নানা কথা লিখছেন। তাঁর অনেক অনুরাগী মনে করেন, বাংলা গানের নতুন পথের দিশারি তিনি। কেউ এমনও লিখেছেন, প্রতিভা, এমনকি তার চেয়েও বড় কোনো শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে হ্যাপি আখান্দ্ তা-ই। কথাটা আবেগের, তবে বিশ্লেষণ করে প্রমাণের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। অনুজ বা অগ্রজ শিল্পীদের কাছেই তাঁর গল্প শোনা হয়েছে নানা সময়ে। ‘ঘুড্ডি’ ছবির ‘কে বাঁশি বাজায় রে’র দৃশ্য ছাড়া তাঁর তেমন কোনো ভিডিও পাওয়া যায় না। মেলে না খুব বেশি ছবিও। এসবের ধারও ধারতেন না হ্যাপিরা। গানটাই ছিল তাঁদের কাছে মুখ্য। যেখানে যেতেন, গান নিয়েই যেতেন, থাকতেন গান নিয়ে।
হ্যাপির গানগুলোর মধ্যে ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘আমি আবার আসব ফিরে’, ‘চল যাই চলে দূরে বহু দূরে’, ‘সবাই যখন ঘুমে’সহ আরও বেশ কিছু গান। ১৯৭৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দের সঙ্গে একটি ব্যান্ড গড়েন হ্যাপি। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডটি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর হ্যাপীর নামে ব্যান্ডের নামকরণ করেছিলেন ‘হ্যাপি টাচ’।
জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন হ্যাপি আখান্দ্। জীবনকালে তাঁকে নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় মাইলসের শাফিন আহমেদ বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে যেকোনো একটা হাতে তুলে দিলেই হ্যাপি আখান্দ্ সেখান থেকে মিউজিক্যাল কিছু বের করে আনতেন। সব বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন। এমনকি বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও সক্রিয় বা সরব থাকতেন। সব সময় দেখেছি, হ্যাপি গানের ভেতর ঢোকার উপায় পেয়ে যেতেন। এমনও সময় ছিল, ঘরে চার-পাঁচজন আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো সবার জন্য অ্যাকুয়াস্টিক গিটার নেই। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পকেট থেকে ম্যাচের কাঠি বের করে সেটা দিয়েই কিছু একটা বাজাতেন হ্যাপি। প্রখর মিউজিক সেন্স ছিল। কোনো গানে যদি কঠিন কোনো নোট থাকত, সবার আগে হ্যাপীর কানে বাজত। কোনো নোট মিস করতেন না। অন্যরা হয়তো খুঁজছে নোট, কিন্তু হ্যাপি ঠিকই বের করে ফেলেছেন। তাঁর জীবনে মিউজিক ছাড়া আর কিছু ছিল না।’
পুরোনো কাগজেও হ্যাপি আখান্দের তেমন কোনো সাক্ষাৎকার বা তাঁকে নিয়ে লেখা পাওয়া যায় না। যেটুকু তথ্য, তা লাকী আখান্দের সঙ্গে কথা বলেই জানা যায়। নিজের শেষ সময়ে আরমানিটোলার বাসায় অসুস্থ অবস্থায় দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে আদরের ছোট ভাইটির স্মৃতিচারণা করেন অগ্রজ। সেদিন তাঁর চোখে দেখেছিলাম হ্যাপীকে, তাঁর মুখে শুনেছিলাম হ্যাপিকে। বড় লাকী আখান্দের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। জীবনকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে যা জেনেছি, হ্যাপিকে শিখিয়েছি। হ্যাপিকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। তখন আমাদের অনেক অভাব ছিল, দুঃখ-যন্ত্রণা ছিল। তবে সংসারে যদি অভাব না থাকত, আমাদের ভেতরে যদি কষ্ট না থাকত, তাহলে আমাদের ভেতরে মিউজিক ঢুকত না।’
হ্যাপির ১০ বছরের বড় ছিলেন লাকী আখান্দ্। তাঁর কাছেই গল্পটা শোনা। হ্যাপির জন্মের পরে তাঁর হাতে একটি পয়সা গুঁজে দেন বড় ভাই লাকী। চার-পাঁচ দিন পর হ্যাপিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার সময় তাঁর হাতে গুঁজে দেওয়া সেই পয়সা পাওয়া যায়। হ্যাপির গানের হাতেখড়ি হয় শৈশবে, আট বছর বয়সে। এক স্মৃতিচারণায় লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘আমরা দুই ভাই একসঙ্গে অনেক গান করেছি। আমার সঙ্গে বাজাত হ্যাপী। ১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রের দোকান বুদ্ধু অ্যান্ড কোংয়ের বুদ্ধুদাকে দিয়ে ২৫০ টাকা দামের একটা স্প্যানিশ গিটার বানালাম। দুই ভাই মিলে সেই গিটার নিয়ে কত গান যে করলাম!’ আরেক দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লাকী আখান্দ্, ‘১৯৭৫ সালে কলকাতায় এক বাসায় মান্না দের দেখা পেয়ে গেলাম। সঙ্গে ছিল হ্যাপির গাওয়া “আবার এল যে সন্ধ্যা”র রেকর্ড। বাজিয়ে শোনালাম। মুগ্ধতা নিয়ে মান্না দে বললেন, “কে গাইছে?” বললাম, হ্যাপি, আমার ছোট ভাই । মান্না দে বললেন, “দারুণ গায়, চমৎকার থ্রোয়িং!” শোনা যায়, রাহুল দেববর্মনও একবার হ্যাপি আখান্দের প্রশংসা করেন।’
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের পর জাতীয় দিবসগুলোতে গণসংগীতে গাইতেন হ্যাপি। পৃথিবীর নানা ধাঁচের সংগীত শুনে শুনে ও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুণী শিল্পীর সান্নিধ্যে এসে নিজের মতো করে চর্চা করতেন তিনি।
হ্যাপির গানগুলোর মধ্যে ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘আমি আবার আসব ফিরে’, ‘চল যাই চলে দূরে বহু দূরে’, ‘সবাই যখন ঘুমে’সহ আরও বেশ কিছু গান। ১৯৭৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দের সঙ্গে একটি ব্যান্ড গড়েন হ্যাপি। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডটি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর হ্যাপীর নামে ব্যান্ডের নামকরণ করেছিলেন ‘হ্যাপি টাচ’। ১৯৯৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দের উদ্যোগে বের হয় হ্যাপির একমাত্র একক অ্যালবাম ‘শেষ উপহার’। তার প্রচ্ছদে লেখা ছিল, ‘বন্ধুরা আমার গান গেয়ো, আমাকে বাঁচিয়ে রেখো: জিয়া হাসান আখান্দ্ হ্যাপি।’
১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘মেলা’ অ্যালবামের অন্তর্ভুক্ত ‘পালকি’ গানে হ্যাপি আখান্দের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে ফিডব্যাক। গানটি ছিল আহমেদ ইউসুফ সাবের ও মাকসুদুল হকের যৌথ রচনা। গানের ভূমিকার কয়েক লাইন ছিল এ রকম, ‘সেদিন ছিল ফিডব্যাকের শীতকালীন মহড়া। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭। এক হিমেল সন্ধ্যা। হঠাৎ একটি খবর চমকে দিল আমাদের। হ্যাপী নেই। থেমে গেল মহড়ার উচ্ছ্বাস। শিল্পীর মৃত্যু নেই। আমাদের বিশ্বাস, হ্যাপী আখান্দের মৃত্যু নেই। তাঁর এই চলে যাওয়া মৃত্যুযাত্রা নয়। অন্য সুরের ভুবনে বরবেশে এ যেন হ্যাপীর পালকি চড়ে মহাপ্রস্থান। তাঁকে বলে দাও, আমি সেদিনের কথা ভুলিনি...’।
হ্যাপিকে ভুলে যাননি তাঁর বন্ধুরা, হ্যাপির গান গাইছেন বছরের পর বছর।