সর্বস্তরের মানুষ, শিল্পী ও কলাকুশলীর শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়েছে
সর্বস্তরের মানুষ, শিল্পী ও কলাকুশলীর শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়েছে

শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও চোখের জলে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে বিদায়

আগেই জানানো হয়েছিল, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ বেলা ১১টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। হাসপাতালের হিমঘর ও বারিধারার পার্ক রোডের বাড়ি হয়ে মরদেহবাহী গাড়ি পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছে যায়। আগে থেকেই সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা সব ধরনের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখেন। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পী, কলাকুশলী, ভক্ত ও স্বজনেরা। শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা ও চোখের জলে বিদায় জানান দেশের এই কিংবদন্তিকে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে বিদায়ী অনুষ্ঠানের শেষটা হয় সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের বক্তব্য ও এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। বক্তব্যে জোট সভাপতি বলেন, ‘এই সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা বলতে চাই, দৈহিকভাবে চলে গেলেও একজন শিল্পীর মৃত্যু হয় না, তাঁর যে দেশপ্রেম, সেটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৭১ সালে তিনি “জয় বাংলা বাংলার জয়” গানটি লিখেছেন, যা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে। চলচ্চিত্রে যেখানে বাণিজ্যিক, সেখানে তিনি কাব্যময়তা এনেছেন। আমাদের গানকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।’

শহীদ মিনারে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে কথা বলছেন কুমার বিশ্বজিৎ

গাজী মাজহারুল আনোয়ার বাংলা গানে একটি মাইলফলক তৈরি করেছেন উল্লেখ করে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘গাজী ভাই আমাদের বাংলা গানের কালপুরুষ। তাঁকে দেখেই অনেকে গান লেখা শিখেছে। তিনি “জয় বাংলা বাংলার জয়” লেখার পর যদি আর গান না-ও লিখতেন, তবু তিনি চিরস্মরণীয় থাকতেন। এই গান আমাকেও দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা তাঁর কাছে সারা জীবন ঋণী থাকব, কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি এমন উচ্চতায় বাংলা গানকে নিয়ে গেছেন, সেটা একটি মাইলফলক। ওই জায়গায় যাওয়া তো প্রায় অসম্ভব, এরপরও বর্তমান প্রজন্ম যদি তাঁকে অনুসরণ করে, তাহলেও বাংলা গান সমৃদ্ধ হবে।’

শহীদ মিনারে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শেখ সাদী খান, সাবিনা ইয়াসমীন, নকীব খান, কুমার বিশ্বজিৎ, মনির খান, আসিফ ইকবাল, মানাম আহমেদ, ইমন সাহা, ইথুন বাবুসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা গীতিকবির প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মৃতিচারণাও করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার সাধারণ মানুষও আসেন গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে শ্রদ্ধা জানাতে।

শেষ বিদায়ে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে

এদিকে সর্বস্তরের মানুষ, শিল্পী ও কলাকুশলীর শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়েছে। মরদেহ শহীদ মিনারে পৌঁছার পরপরই পরিবারের সদস্য ও সবার উপস্থিতিতে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ নেওয়া হয় তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) প্রাঙ্গণে। কয়েক প্রজন্মের চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা ছাড়া এখানে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। মরদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রদ্ধেয় গাজী মাজহারুল আনোয়ার একজন কিংবদন্তি গীতিকার ও কাহিনিকার। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক। তাঁর প্রথম গান “আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল”; এখনো সেই গান যখন বাজে, আমাদের প্রত্যেকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় “জয় বাংলা বাংলার জয়”, “একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল”সহ অসংখ্য গান তিনি রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র “নান্টু ঘটক” কেমন সাড়া জাগিয়েছিল, তা সবাই জানেন। তিনি আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন কিন্তু তাঁর কালজয়ী সৃষ্টিগুলোর মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন। আমি মনে করি, যত দিন বাংলা গান থাকবে, তত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন। তিনি অকালে চলে গেছেন। তেমন অসুস্থ ছিলেন না। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি যদি থাকতেন, তাহলে আমাদের সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করে যেতে পারতেন।’

এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জানাজায় অংশ নেওয়া চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীদের একাংশ

এফডিসির প্রশাসনিক ভবনের সামনে শেষযাত্রার এই অনুষ্ঠানে তারকাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রোজিনা, ওমর সানী, অরুণা বিশ্বাস, সাইমন, বাপ্পী, ফোয়াদ নাসের বাবু, মিল্টন খন্দকার, এস ডি রুবেল, কিশোর, সাব্বিরসহ অনেকে। পাশাপাশি শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান ইলিয়াস কাঞ্চন ও নিপুণ। আরও ছিল পরিচালক সমিতি, বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব, এফডিসি প্রশাসন, চলচ্চিত্র পরিষদ, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপক সমিতি। পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান বলেন, ‘গাজী ভাইয়ের মধ্যে ম্যাজিক্যাল ব্যাপার ছিল। তিনি অবস্থা বুঝে পাঁচ মিনিটে গান লিখে দিতে পারতেন। সেই গানগুলো সবই জনপ্রিয়। তাঁর মতো গুণীজন আমরা আর পাব না।’ কাজী হায়াৎ বলেন, ‘গাজী ভাইয়ের মৃত্যুতে দেশের মানুষের হৃদয় কাঁদছে। এমন ভাগ্য নিয়ে কতজন চলে যেতে পারেন? গাজী ভাইয়ের মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হলো।’ রোজিনা বলেন, ‘তিনি একজন শিশুর কাছ থেকেও শিখতে চাইতেন। কোনো দিন তাঁর মধ্যে অহংকার দেখিনি।’ কাঁদতে কাঁদতে এফডিসিতে ঢোকেন চিত্রনায়িকা অঞ্জনা। তিনি বললেন, ‘কী থেকে কী হয়ে গেল! আমি তো অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম। চলচ্চিত্রে আমার অন্যতম অভিভাবক ছিলেন। তাঁর এই চলে যাওয়াতে আমরা কী হারিয়েছি, সময় যত যাবে, ততই উপলব্ধি করতে পারব।’ এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

বাবার মরদেহ পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দুই সন্তান দিঠি আনোয়ার ও সরফরাজ আনোয়ার

এফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ নেওয়া হয় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই কার্যালয়ে। এখানে চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ ও শিল্পীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। শোক বইয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে স্মৃতিকথাও লেখা হয়। এখানে দ্বিতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গুলশান আজাদ মসজিদে তাঁর তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাদ আসর জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে। সেখানে মা খোদেজা বেগমের কবরে সমাহিত করা হয়েছে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের এই কিংবদন্তিকে।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

অসুস্থতা অনুভব করলে গতকাল রোববার সকালে গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে বারিধারা পার্ক রোডের বাসা থেকে দ্রুত গুলশানের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।সেখানে চিকিৎসকেরা ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। নন্দিত গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা গানের শ্রেষ্ঠতম গীতিকবি হিসেবে পরিচিত তিনি। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ২০ হাজারের বেশি গান লিখেছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননাসহ শতাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। গানের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চিত্রনাট্য রচনায়ও তাঁর নামটি উজ্জ্বল।