বিটিএস
বিটিএস

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ল কে-পপ

‘করোনাকালে যখন বাসায়, তখন একটা কে-ড্রামা দেখা শুরু করি। ভালোই লাগে। ওই সময়ই আবার বিটিএসের “ডায়নামাইট” গানটা বের হয়। সেটা আবার বিলবোর্ডের হট ১০০-এর ১ নম্বরে ছিল বেশ কিছুদিন। “ডায়নামাইট” থেকে অন্য গানের দিকে যাওয়া। মূলত ওদের গানের গল্পগুলা ভালো লাগে,’ বলছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিন যাঈমাহ্ কবির।

কে–পপ নিয়ে জাহিনের কিন্তু খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কাছের বন্ধুরা কে-পপের ভক্ত ছিল। ভক্ত ছিল তাঁর বোন। তারা যখন দেখত, তাদের নিয়ে মজা করতেন জাহিন, বলতেন, ‘কী যে দেখো এসব!’ সেই জাহিন এখন কে-পপের পাঁড় ভক্ত।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কে–পপ নিয়ে উন্মাদনা, বিস্তর চর্চা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস জানালেন, কে-পপের জগতে মেয়েদের গ্রুপ ‘মামামো’–কে তাঁর বেশি ভালো লাগে। ব্যান্ডটির সদস্য হোয়াসাকে বেশি ভালো লাগে। হোয়াসার কথা বলার ধরন, তাঁর বোল্ড ভয়েসের গান তাঁকে বরাবরই মুগ্ধ করে।

কে-পপ নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? কে-পপের প্রতি এত টানই-বা কিসের? বিশ্বসংগীতে কে-পপের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ময়নাতদন্ত করা যাক।

কে-পপ কী

ব্ল্যাকপিংকের সদস্যরা

সংগীতের প্রভাবশালী একটি ধারা কোরিয়ান পপ বা কে-পপ।এতে রয়েছে হিপহপ, ইলেকট্রনিক ড্যান্স, জ্যাজ, আরঅ্যান্ডবি, রকের মিশেল। আকর্ষণীয় সুর, ব্যতিক্রম কোরিওগ্রাফি, প্রতিভাবান শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কে-পপ শুধু মিউজিকই নয়, হয়ে উঠেছে ‘কালচারাল ফেনোমেনন’।

কে-পপ লাইভ: ফ্যানস, আইডলস অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া পারফরম্যান্স নামে একটি বই লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের অধ্যাপক সুক-ইয়ং কিম। তিনি মার্কিন গণমাধ্যম সিবিএস নিউজকে বলেছেন, ‘এটি সংগীতের চেয়েও বেশি কিছু। কোরিওগ্রাফি, ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল মিলিয়ে এটি বিনোদনের সম্পূর্ণ একটি মাধ্যম। আমি মনে করি, কে-পপ এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ট্রেন্ড পিছিয়ে পড়ছে।’

আধুনিক কে–পপ

বলা হয়, ১৯২৬ সালে সংগীতশিল্পী ইউন সিম–দুকের ‘হিম অব ডেথ’–এর মধ্য দিয়ে আধুনিক কে–পপের যাত্রা শুরু। এটিই প্রথম কোনো কেক–পপ গান, যেটি জাপানেও প্রকাশিত হয়েছিল।

পঞ্চাশের দশকের গায়িকা লি মি জা–কে বলা হয় প্রথম ‘কে–পপ ডিভা’। ষাটের দশকের পর কে–পপ ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করে। তবে তখনো মার্কিন ও জাপানি লোকসংগীতের প্রভাবে অনেকটা ঢাকা পড়ে ছিল কোরিয়ান সংগীত।

নব্বইয়ের দশকে কে–পপে ‘সেও তাইজি অ্যান্ড বয়েজ’ ব্যান্ডের হাত ধরে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায়। ব্যান্ডটির তিন সদস্য সেও তাইজি, ইয়াং হিউন-সুক ও লি জুনো মিলে মার্কিন র‌্যাপ ও কোরীয় লিরিকের সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হন। ১৯৯২ সালে একটি টেলিভিশন শোতে ব্যান্ডটি পারফর্ম করে। কিন্তু জুরির কাছ থেকে সবচেয়ে কম নম্বর পায়। তাতে কী? ওই শোতে তাদের গাওয়া ‘আই নো’ গানটি ১৭ সপ্তাহ ধরে কোরীয় সংগীতের টপ চার্টে ছিল। যাত্রার চার বছরের ব্যবধানে ১৯৯৬ সালে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। এই ব্যান্ড মোট চারটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে।

একবিংশ শতাব্দীতে কে–পপকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে ‘গ্যাংনাম স্টাইল’। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই কোরীয় গায়ক ও র‍্যাপার সাইয়ের কে–পপ গানটি রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। সোয়া চার মিনিটের গানটির ভিডিওতে সাইয়ের অদ্ভুত নাচের ভঙ্গি আলাদা করে নজর কাড়ে।

বিটিএস, ব্ল্যাকপিংক এবং...

বিটিএসের পরিবেশনা

বিটিএসের হাত ধরেই তরুণদের অনেকে কে–পপের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। ফলে কে–পপ নিয়ে আলোচনায় সবার আগে এই ব্যান্ডের নামই আসে। বিটিএস নিয়ে জাহিন বলছিলেন, ‘ব্যান্ডটির সদস্যদের লাইফ স্ট্রাগলটা আমাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। এ জন্য কাছের মনে হয়।’

‘বিটিএস আর্মি অব বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন সানজিদা নাসরিন। গত বছরের জুনে বিটিএসের সদস্যদের নিয়ে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘নিজেরা চেষ্টা করে এত দূর এসেছে। যারা স্ট্রাগল করে, তাদের জন্য এটা অনেক ইন্সপায়ারিং। ব্যান্ডের সদস্যরা খুব সাধারণভাবে নিজেদের উপস্থাপন করেন।’

‘স্প্রিং ডে’, ‘ডায়নামাইট’, ‘বাটার’–এর মতো গান দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ কে-পপ ব্যান্ডে পরিণত হয়েছে বয় ব্যান্ড বিটিএস। এই সময়ের আলোচিত কে–পপ বয় ব্যান্ডের মধ্যে রয়েছে সেভেনটিন, এনসিটি, স্ট্রে কিডস।

বয় ব্যান্ডের সঙ্গে সমানতালে গার্ল ব্যান্ড এগিয়ে চলেছে। গার্ল গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্ল্যাকপিংক। বিটিএস নাকি ব্ল্যাকপিংক, এ নিয়ে কে–পপের অনুরাগীদের মধ্যে বরাবরই দ্বৈরথ চলে আসছে।

একসময় শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল গার্লস জেনারেশন। মাঝে কয়েক বছরের বিরতি ভেঙে আবারও গানে ফিরেছে ব্যান্ডটি। হালের আলোচিত গার্ল ব্যান্ডের মধ্যে রয়েছে টোয়াইস, নিউ জিনস, মামামো, রেড ভেলভেট ইত্যাদি।

কে–পপ ব্যান্ডে শুধু কোরীয় সংগীতশিল্পীরাই থাকেন না; বাইরের শিল্পীরাও কে–পপ ব্যান্ডে রয়েছেন। ব্ল্যাকপিংকের তারকা গায়িকা লিসা থাইল্যান্ডের মেয়ে। কোরিয়ায় গিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছেন। গার্ল গ্রুপ ব্ল্যাকসোয়ানের চার সদস্যের কেউই দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক নন।

পথটা সহজ নয়

দক্ষিণ কোরিয়ার গায়ক-গীতিকার ও র‍্যাপ সংগীতশিল্পী সাই ও তাঁর গ্যাংনাম স্টাইল

কে–পপ শিল্পীদের গান, র‍্যাপ, নাচ, অভিনয়—সবকিছুতেই দখল থাকতে হয়। বিদেশি ভাষাও শিখতে হয়। এসবে প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় বেশ কয়েকটি এজেন্সি রয়েছে। এসব এজেন্সির ব্যানারেই ঘটে নতুন নতুন শিল্পী ও ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ। অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণদের বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষণ দেয় তারা। অনেককে তৈরি করতে ১০ বছরও লেগে যায়। অনেকে আবার ঝরে পড়ে। প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ শিল্পীদের নিয়ে নতুন ব্যান্ডের ঘোষণা দেওয়া হয়। এজেন্সিগুলো এর আগে মোটা অঙ্কের অর্থ ঢেলে শিল্পী ও ব্যান্ড নিয়ে ব্যাপক প্রচার করে। আসলে প্রশিক্ষণ থেকে ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ পর্যন্ত এজেন্সিগুলো প্রচুর অর্থ ঢালে। যত দিন সেই আর্থিক ঋণ শোধ না হয়, তত দিন এজেন্সি থেকে মুক্তি মেলে না। শিল্পী ও ব্যান্ডের ওপর এজেন্সির একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। এজেন্সি তখন যেভাবে চাইবে, সেভাবেই চলতে হবে। এর অবশ্য কারণও আছে। কঠিন সে পথ বেছে নেওয়াটা তাই কম সাহসের নয়!

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিবিএস নিউজ, কোরিয়া টাইমস, এলএ ফিল্ম স্কুল, ৯০ ডে কোরিয়ান, টিন ভোগ