সোহান আলী। শিল্পীর সৌজন্যে
সোহান আলী। শিল্পীর সৌজন্যে

জেন–জিরা কেন সোহান আলীর গান শুনছেন

‘অন্য গ্রহের চাঁদ’, ‘চল দোতং পাহাড়’-এর মতো গান দিয়ে তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সোহান আলী। তরুণ এই শিল্পীর গান, বর্তমান ব্যস্ততার খবর জানাচ্ছেন লতিফুল হক

‘তোমার আকাশ ধরার শখ/ আমার সমুদ্দুরে চোখ, আমি কী আর দেব বলো/ তোমার শুধুই ভালো হোক’, এমন রূপক কথায় গানে গানে মূলত বিরহের কথাই শুনিয়েছেন সোহান আলী। প্রেমের গান বাঙালি পছন্দ করে, সেটা যদি হয় ব্যর্থ প্রেম, তাহলে তো কথাই নেই। তবে কেবল প্রেম নয়, তাঁর গানে উঠে আসে প্রকৃতি, পাহাড়, জঙ্গল আর ঝিরিপথে হাঁটার আনন্দ। সোহান আলী আপাদমস্তক ভবঘুরে। হুটহাট ছুট দেন। নিজের গানের সেই লাইনের মতো, ‘তাই জটিল ধাঁধার শহর ছেড়ে মন পাহাড়েই যায়’।

সোহান আলী। শিল্পীর সৌজন্যে

একবার যেমন গিয়েছিলেন পঞ্চগড়। সীমান্তঘেঁষা এক চা–বাগানে সন্ধ্যার ঠিক পরপর জোনাকিরা উড়ে বেড়ায়। যেন অ্যানিমেশন সিনেমা। স্রেফ এই দৃশ্য দেখবেন বলেই এক বন্ধুকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁবুতে বসে সেই দৃশ্য দেখার প্রভাব হয়তো কেউ খুঁজে নিতে পারেন ‘চল দোতং পাহাড় জুমঘরে/ পূর্ণিমারাত বর্ষাজুড়ে জীবনজুয়ার আসর বসাব’র মতো লাইনে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসার পর সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হয়ে আর বসে থাকতে হয় না। ঠাকুরগাঁও থেকে গান বানিয়ে অন্তর্জালে ছেড়ে দিলেই হলো, সুরই হয়তো খুঁজে নেবে বুয়েন্স এইরেসের কোনো শ্রোতাকে। সোহান আলী মনে করেন, গান প্রকাশের এই স্বাধীনতা তাঁর মতো তরুণ শিল্পীর সামনে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

সোহান আলী। শিল্পীর সৌজন্যে

‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আসার পর শিল্পীদের কারও কাছে ধরনা দিতে হয় না। একটা সময় আপনি যত প্রতিভাবানই হন, একটা লেবেলের মাধ্যমেই আপনাকে সিডি করতে হতো। এই যুদ্ধ আমিও করেছি। এখন এটা নেই। ডিস্ট্রিবিউশন, লাইসেন্স, পাবলিশিং; আমার গানের সব স্বত্ব নিজের। আমার গান আমার হাতে। এই নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না, পুরো রয়্যালটি আমার। অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পরের দিকে ঠিকমতো রয়্যালিটি দিতে চায় না। তাই আমি মনে করি, এখন শিল্পীদের জন্য বড় সুযোগ।’

আজকের এই অবস্থানে আসতে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে সোহানকে। তবে সে গল্পের শুরুটা পঞ্চগড়ে। বাবার চাকরিসূত্রে সোহান সেখানেই বড় হয়েছেন কিনা! পূর্বপুরুষদের কেউ কস্মিনকালেও গানে ছিলেন না। নিজেও গান শেখেননি। তবে মায়ের গলা ছিল ভারি মিষ্টি। কে জানে, সেটাই হয়তো অবচেতন মনে সুরে তুলে দিয়েছিল। আর ছিল জগদল।

বয়ঃসন্ধির সময়ে প্রেম হয়, প্রেম চলে যায়, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া হয়—এসব বিষয় আমার গানে আছে; এভাবেই কোথাও হয়তো একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছে।
সোহান আলী

পঞ্চগড় সদরের জগদল বাজারে একটা ক্লাবের মতো ছিল। সেখানে বড়রা গানবাজনা করতেন। সোহান সেখানে যেতেন খুব। আগ্রহ দেখে একদিন হাতে তুলে দেওয়া হয় তবলা। এভাবেই গান আর বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে যোগ। গান নিয়ে আরও আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাই মাঠে বন্ধুদের কেউ খেলায়, কেউ আড্ডায় ব্যস্ত হলেও গান নিয়েই পড়ে থাকতেন সোহান।

একসময় ঠিক করেন, সংগীত পরিচালক হবেন। ২০০৯ সালে ঢাকায় আসেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। সোহানের ভাষ্যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়াটা ছিল অসিলামাত্র। সংগীতে নিজের স্বপ্নপূরণ করতেই আসলে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। এরপর গিটার শিখেছেন, বন্ধুদের নিয়ে ব্যান্ড গড়েছেন; রেস্তোরাঁ, বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানে কাভারের পর কাভার গান গেয়ে গেছেন। মুশকিল হয় পড়া শেষ করার পর। কী করবেন? নিজের স্টুডিও দেওয়ার পয়সা নেই। সোহান শুরু করলেন ফ্রিল্যান্সিং। জানালেন, তিনি মূলত মিউজিক নিয়েই ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতেন। বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটের সূচনা সংগীত করে দিতেন, এ ছাড়া বেশ কিছু বিদেশি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার আবহ সংগীত করেছেন। ২০১৭-এর দিকে পকেটের অবস্থা একটু ভারী হলো, সব বাদ দিয়ে নিজের মতো করে স্টুডিও গড়লেন। শুরু হলো নতুন এক সোহানের যাত্রা।

সোহান আলী। শিল্পীর সৌজন্যে

২০২১ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গান ‘ছেলে’। এখানেও একটা কিন্তু আছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম গানটা আসে একটি সংগীত প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে। চুক্তির কিছু বিষয় নিয়ে ঝামেলা হয়, সোহান গানটির শিরোনাম বদলে তা নিজের চ্যানেলে প্রকাশ করেন। এই প্রকাশ্যে আসে সোহানের নতুন পরিচয়, তিনি গানও লেখেন। তিনি যে গান লেখেন, এটা তাঁর কাছের বন্ধুরাও জানতেন না। তবে সোহান জানতেন, ‘মিথ্যা’র প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা।

‘এইট-নাইন থেকেই গান লিখি। ছোটবেলায় প্রচুর বই পড়তাম, বিশেষ করে থ্রিলার, রহস্য-রোমাঞ্চ। মাসুদ রানা, (হেনরি রাইডার) হ্যাগার্ড; এভাবেই ফিকশনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। মনে হতো, এত সুন্দর একটা মিথ্যা গল্প; কিন্তু আমার কাছে ভালো লাগছে। নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত ভালো লাগত। তাঁদের মতো আমি চেষ্টা করতাম। এভাবেই লেখার শুরু,’ বলছিলেন শিল্পী।

কোথায় কোথায় গাইতে যান? জানালেন, মূলত তরুণেরা তাঁর শ্রোতা। শিডিউল দেখে জানালেন, স্কুল–কলেজে তাঁর টানা অনুষ্ঠান। তরুণেরা তাঁর গান কেন এতটা পছন্দ করেন? একটু ভাবলেন, তারপর বললেন নিজের ধারণার কথা, ‘বয়ঃসন্ধির সময়ে প্রেম হয়, প্রেম চলে যায়, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া হয়—এসব বিষয় আমার গানে আছে; এভাবেই কোথাও হয়তো একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছে।’
আজকাল বছরজুড়েই কনসার্ট হলেও শীতের সময়েই ব্যস্ততা বেশি থাকে। সেই দীর্ঘ শীতযাত্রারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন এখন সোহান।