সুনিধি নায়েক
সুনিধি নায়েক

সুনিধির শিকড়ে ফেরা

তিন বছর বয়সে সংগীতে হাতেখড়ি। রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে পরিচিতি পেলেও শাস্ত্রীয় সংগীতকেই নিজের শিকড় ভাবেন। কোক স্টুডিও বাংলার ‘সন্ধ্যাতারা’ গেয়ে আলোচনায় সুনিধি নায়েক।

শান্তিনিকেতনের আলো–হাওয়ায় রবীন্দ্রসংগীতের পাঠ নিয়েছেন আসানসোলের মেয়ে সুনিধি। ২০১৮ সালের দিকে বিশ্বভারতীর পড়াশোনা শেষ করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেও ‘ও যে মানে না মানা’, ‘বন্ধু রহো সাথে’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’র মতো রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন সুনিধি। দেড় যুগের বেশি সময় ধরে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিলেও এই ঘরানার সংগীত তাঁকে দিয়ে তেমন একটা গাওয়ানো হয়নি। এ নিয়ে সুনিধির মনে খেদও ছিল।
তাঁর সেই খেদ ঘুচাল কোক স্টুডিও বাংলা। ৮ জুলাই প্রকাশিত ‘সন্ধ্যাতারা’ গানে দেড় যুগের চেনা গলিতে ফিরলেন সুনিধি; ওস্তাদ বিলায়েত খানের বিখ্যাত বন্দিশ ‘ম্যায় বারি বারি যাওঙ্গি’র বাংলা সংস্করণে গাইলেন। গানটিতে বন্দিশের সঙ্গে পপ গানের মিশেল (ফিউশন) আছে। পপ অংশ গেয়েছেন সুনিধির সুরসঙ্গী, সংগীতশিল্পী অর্ণব। এর আগে ‘এই তো তোমার আলোকধেনু’সহ একাধিক রবীন্দ্রসংগীতে এ যুগলকে পাওয়া গেলেও ফিউশনে এবারই প্রথম।

সুনিধি নায়েক

‘সন্ধ্যাতারা’ প্রকাশের সাত দিনের ব্যবধানে কোক স্টুডিও বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে ৪০ লাখের বেশিবার ‘ভিউ’ হয়েছে। ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো মন্তব্য জমা পড়েছে। বেশির ভাগ শ্রোতা গানের সুর, গায়কি ও পরিবেশনার প্রশংসা করলেও কেউ কেউ ‘ফিউশন’ নিয়ে সমালোচনাও করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে সুনিধি নায়েক জানান, গানটি প্রকাশের পর এতটা সাড়া পাবেন কল্পনাও করেননি, ‘ভেবেছিলাম, ট্রাডিশনাল বন্দিশের সঙ্গে পপ গানের ফিউশনকে অনেকে না–ও মেনে নিতে পারে। তবে গানটি প্রকাশের পর ভালো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। কেউ কেউ সমালোচনাও করছেন। সব ধরনের প্রতিক্রিয়াই গ্রহণ করতে চাই।’

সুনিধি নায়েক

সুনিধির শিকড় শাস্ত্রীয় সংগীত
সাত বছর বয়সে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম পেয়েছেন সুনিধি নায়েক। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীসহ বেশ কয়েকজন ওস্তাদের কাছে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন তিনি। শাস্ত্রীয় সংগীতকেই নিজের শিকড় মানেন সুনিধি।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে দশটি ঠাট আছে। একেকটি ঠাটের বেশ কটি রাগ। একেকটি রাগের ওপর একেকজন ওস্তাদ একেক সুর তৈরি করেন; সেই সুরগুলোকেই  বলে বন্দিশ। রাগ ইমনের ওপর ভিত্তি করে ‘ম্যায় বারি বারি যাওঙ্গি’ সৃষ্টি করেন ওস্তাদ বিলায়েত খান। ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ওস্তাদ আজমত হোসেন খান প্রথমবার এটি রেকর্ড করেন।

সুনিধি নায়েক

২০১০ সালে এক গুরুর কাছে বন্দিশটি শিখেন সুনিধি নায়েক। বছর দুয়েক আগে গোয়া শহরের এক বন্ধুর সঙ্গে হিন্দিতে বন্দিশটি রেকর্ড করেন সুনিধি। তাতে মন ভরেনি, ঢাকার সংগীতশিল্পী ও সুরকার অদিত রহমানকে বন্দিশটি পাঠিয়ে বলেন, কিছু করা যায় কি না দেখো। গিটারিস্ট সাদুল ইসলামের সঙ্গে বসেন অদিত। সাদুলের গিটারে গানের অনুভূতিটা খাপে খাপে মিলে যায়। গানটার সঙ্গে তখনো কোক স্টুডিও বাংলার যোগ ঘটেনি; হিন্দি গানটি নিজেই পরিবেশন করে মুক্তির দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে গানটি কোক স্টুডিওতে ‘পিচ’ করা হলে তাঁরা রাজি হন। হিন্দি বন্দিশটি বাংলায় রূপান্তর করে সেটির সঙ্গে পপ গান যুক্ত করে নির্মিত হয় ‘সন্ধ্যাতারা’।

অর্ণব ও সুনিধি নায়েক

সন্ধ্যাতারা: যেন অর্ণব–সুনিধিরই জীবনচিত্র
গানটি রেকর্ডিংয়ের ফাঁকে বারবার অর্ণব-সুনিধির মনে হয়েছে, এই গল্পটা তাঁদের চেনা! একসময়ের গোঁড়া রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমী সুনিধির সঙ্গে পপ কালচার, জ্যাজ শুনে বেড়ে ওঠা অর্ণবকে সংগীতই এক করেছে। ‘সন্ধ্যাতারা’ যেন শাস্ত্রীয় সংগীতের মেয়ে সুনিধির সঙ্গে আধুনিক গানের ছেলে অর্ণবেরই যুগলবন্দী। সুনিধি বললেন, ‘পপ ও বন্দিশটাকে ফিউশনে মেলানোর সময় সত্যিই আমাদের মনে হয়েছে, এটা আমাদেরই গল্প।’ যেন জীবনের চিত্রনাট্য ধরে বন্দিশ গাইলেন সুনিধি, পপ গানের অংশ গাইলেন অর্ণব।
শুধু গান নয়, সেট ডিজাইনের সময়ও দুজনের চরিত্রকে মাথায় রেখেছে কোক স্টুডিও বাংলা। ব্যক্তিগত জীবনে সুনিধি বেশ গোছালো আর অর্ণব বোহেমিয়ান; কোনো একভাবে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারেন। তাঁদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখেই সেটে আলাদা দুটি ঘর করা হয়েছে। সুনিধির ঘরে আলমারি, আয়না দেখা গেছে, অর্ণবের ঘরে শুধুই একটি চেয়ার ও একটি বাতি। সুনিধির ভাষ্যে, ‘ওই রকম করেই ও (অর্ণব) বাঁচতে চায় (হাসি)।’

সুনিধি ও অর্ণব

কলকাতার মেয়ে ঢাকার ছেলে
রবীন্দ্রসংগীতের পর এবার মৌলিক গানে মনোযোগী হয়েছেন সুনিধি। পাঁচটি গান নিয়ে শিগগিরই আড়ালে নামে নিজের প্রথম অ্যালবাম নিয়ে আসছেন সুনিধি। পাঁচটি গানের রেকর্ডিং হয়ে গেছে, দুটি গানের ভিডিও চিত্র ধারণ করা হবে। কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি একাধিক গানের সুর ও সংগীতায়োজনও করেছেন সুনিধি।
অর্ণবকে বিয়ে করে ঢাকাতেই থিতু হয়েছেন কলকাতার মেয়ে সুনিধি। বলেন, ‘নতুন দেশে ক্যারিয়ার গড়া কঠিন—সেটা জানি, তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, সবার সহযোগিতা পাব।’ গান রেকর্ডিংয়ের পাশাপাশি ঢাকায় নিয়মিত শো করছেন সুনিধি, ১৫ জুলাই আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে একটি শো করেছেন। আজ কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে গাজীপুরে একটি শো রয়েছে। গানের পাশাপাশি অভিনয়ও করছেন সুনিধি—এমন গুঞ্জনও ছড়িয়েছে। কয়েকটি প্রস্তাব পেয়েছেন স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন থিয়েটারশিল্পী। ছোটবেলা থেকেই থিয়েটার করতে দেখেছি। বিশ্বভারতীতে ডান্স ড্রামা করেছি। একটাই তো জীবন, যা পারি কেন লুকিয়ে রাখব? ভালো চরিত্র পেলে অবশ্যই করব।’