করোনা মহামারিতে যখন সবাই ঘরবন্দী, তখন এক স্বপ্নচারী তরুণ ঘরে-বাইরে আর প্রকৃতির কাছে তাঁর স্বপ্ন বুনছিলেন। করছিলেন সংগীতসাধনা। সেই সাধনা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবের মাধমে চলে আসে মানুষের হাতের মুঠোয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে জায়গা করে নেয় সবার মনে। ‘মন ভালা না রে, তোর পিরিত ভালা না’—গানটির মাধ্যমে কণ্ঠশিল্পীও চলে আসেন সবার নজরে। সবাই যখন এই তরুণের গানে মুগ্ধ, তখন আবারও তিনি ঝড় তুললেন কোক স্টুডিও বাংলার মাধ্যমে। কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম মৌসুমের ‘নাসেক নাসেক’ গানটি দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন লাখ লাখ দর্শকশ্রোতার মধ্যে।
পাঠক, লাইনগুলো পড়তে পড়তে আপনাদের মনের জানালায় উঁকি দিচ্ছে কোন মুখটি? হ্যাঁ, সেই স্বপ্নচারী তরুণ হলেন অনিমেষ রায়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এই তরুণের গান শুনলে মনে হয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আসা নদীর শীতল পরশের কথা। যে পরশ ছুঁয়ে যায় মন-প্রাণ।
১৮ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় মুক্তি পায় কোক স্টুডিও বাংলা দ্বিতীয় মৌসুমের তৃতীয় গান ‘নাহুবো’। এই গানেও নিজের জাতিগোষ্ঠী হাজংয়ের সংস্কৃতি তুলে এনেছেন অনিমেষ রায়। প্রথম গান ‘নাসেক নাসেক’-এর মতো এবারও সাড়া পড়ে যায় তাঁর ‘নাহুবো’ গানটি নিয়ে। হাজং ভাষায়ই অনিমেষ রচনা করেছেন এবং গেয়েছেন দুটি গানই।
অনিমেষ বলেন, ‘এটা যে আমার কাছে কত বড় আনন্দের বিষয়, তা বলে বোঝাবার নয়। হাজং পরিবারে জন্ম হওয়ায় আমার মাতৃভাষা এটা। যখন থেকেই গানের প্রতি টান অনুভব করতাম, নিজের ভাষাতেই লিখতাম। এটা আমার কাছে একধরনের শিকড়ের সৌন্দর্যের মতো। তবে বাংলা ভাষা তো আমার দেশের ভাষা। বড় হতে হতে আমি বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, পড়াশোনা করেছি। এখানেও মায়ের ঘ্রাণ আছে।
আমাদের হাজং ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। হয়তো একদিন তা হবে। কিন্তু কোক স্টুডিও বাংলার কারণে আমাদের হাজং ভাষার গান মর্যাদা পেয়েছে। এ জন্য কোক স্টুডিও বাংলার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।’
নাহুবো গানটির কথা ও ভাবনার বিষয়ে অনিমেষ রায় জানান, ‘গানটি আমার নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। সামাজিক প্রত্যাশার চাপে মাথা নত না করে নিজের শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে মানুষের বাঁচার অধিকার আছে, তা মনে করে লিখেছি। ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ, কারও জন্য নিজেকে কষ্ট না দেওয়া এবং গানের প্রতি ভালোবাসার কথা তুলে ধরেছি। আমি গানটি নিজের জন্যই লিখেছিলাম। আমি গাইব আর আমার হাজং ছোট ভাইবোনেরা এটার সঙ্গে নাচবে—এমন ভাবনা থেকেই গানটি লেখা। পরিকল্পনাও করে রেখেছিলাম। তখন কোক স্টুডিও বাংলার কম্পোজার সায়ন্তন মাংসাং গায়ক ও সংগীতশিল্পী অর্ণবদার সঙ্গে এই পরিকল্পনা ভাগাভাগি করলে তিনি কোক স্টুডিও বাংলার জন্য নাহুবোকে নির্বাচিত করেন।
গানটিতে অনিমেষ রায়ের সঙ্গে আছেন কক্সবাজারের র্যাপশিল্পী সোহানা রহমান। যাকে ‘ডটার অব কোস্টাল’ আখ্যা দিয়েছে কোক স্টুডিও বাংলা কর্তৃপক্ষ। গানটিতে হাজং ও উপকূলীয় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। র্যাপ অংশটুকু রচনা করেছেন সোহানা। কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়া, গান লেখা এবং গাওয়া নিয়ে সোহানা বলেন, ‘আমি আমার এলাকায় র্যাপসংগীত পরিবেশন করি। যখন আমাকে বলা হলো এমন একটা প্ল্যাটফর্মে গান গাইতে হবে, আমি তো আনন্দে অভিভূত।
প্রায় প্রতিটি মানুষকেই পারিবারিক ও সামাজিক নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়ে গান লিখতে এবং গাইতে পেরেছি—এটা আমার কাছে বড় পাওয়া। কক্সবাজারের মানুষের বাইরে এখন সারা দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসছে। কোক স্টুডিও বাংলার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
নাহুবো গানটির সংগীতায়োজন করেছেন সায়ন্তন মাংসাং। অনিমেষ রায় ও সোহানা রহমান ছাড়াও গানটিতে কণ্ঠ মিলিয়েছেন সায়ন্তন মাংসাং, সাদুল ইসলাম ও ইমরান আহমেদ।