একটা রাখাল দুটো গরু নিয়ে যাচ্ছিল। একটা খুব মোটা, আর একটা খুব রোগা। একজন উকিল সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি রাখালকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘তোর ও গরুটা অত মোটা কেন, আর এটা এত হালকা কেন? এটাকে খেতে দিস না?’
রাখাল উকিলকে চিনত। বলল, ‘আজ্ঞে না। মোটাটা উকিল, আর রোগাটা মক্কেল। রাগ করবেন না।’
কৌতুকটির স্রষ্টা রজনীকান্ত সেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যায় তিনি। গলার একধরনের কর্কট রোগে আক্রান্ত। বইয়ের স্বত্ব বিক্রির টাকায় চলছে চিকিৎসা। অস্ত্রোপচারও হয়েছে। ইংরেজ ডাক্তার স্বজনদের তবু বলে দিয়েছেন, আয়ু আছে আর মোটে কয়টা দিন। রজনীকান্তরও সেই কথা অজানা ছিল না। কথা বলতে পারতেন না। ভরসা তাই কাগজ-কলম। মনের কথা সব লিখে রাখতেন। সেই বৈরী সময়েই ডায়েরিতে লিখেছিলেন এ রকম চটুল কথা।
আসলে মানুষটাই ছিলেন এ রকম। বাবা ও কাকার পেশা ছিল ওকালতি। নিজেও সে পথে গিয়েছিলেন। মক্কেলও জুটেছিল বেশ। কিন্তু গান-কবিতার নেশায় মামলার পেছনে সময় দিতে পারতেন না। দিনে দিনে মক্কেলরা অন্য উকিলের ঠিকানা খুঁজে নিলেন। বন্ধু শরৎ কুমার রায়, যিনি ছিলেন প্রথমদিকের বরেন্দ্র অঞ্চল গবেষক, তাঁকে এক চিঠিতে লেখেন, ‘আমি আইনব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোনো দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালোবাসিতাম; কবিতাকে পূজা করিতাম; কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।’
আজ ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলা গানের অমর গীতিকার ও কবি রজনীকান্ত সেনের প্রয়াণবার্ষিকী। আজ থেকে ১১৩ বছর আগে, ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রয়াত হন। আমাদের এই বাংলাদেশেরই মানুষ তিনি, জন্মেছিলেন পাবনা জেলায়।
ওকালতি করেছেন রাজশাহীতে। মাত্র ৪৫ বছরের জীবনের বেশির ভাগ সময় এ অঞ্চলেই কাটিয়েছেন। জন্ম ১৮৬৫ সালে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বছর চারেকের ছোট ছিলেন তিনি। তবে চিন্তায় ছিলেন রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে।
গান ব্যাপারটা রজনীকান্তের ভেতরেই ছিল। তাঁর মা-বাবা, দুজনই ছিলেন গানের মানুষ। কিন্তু এই রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে আমরা কতটা জানি? এই প্রজন্মই-বা কতটা জানে? বাংলা ভাষার যেসব কবি কবিতা রচনার পাশাপাশি সংগীত রচনায়ও বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, তাঁদের একজন রজনীকান্ত সেন। ‘পঞ্চকবির গান’ বলে একটা টার্ম চালু আছে। অন্য চারজন হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও অতুলপ্রসাদ সেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা বেশি, এরপর নজরুল। তাঁদের গানের সংখ্যাও বেশি। তারপর রয়েছেন দ্বিজেন্দ্রলাল ও অতুলপ্রসাদ।
সবচেয়ে কম চর্চা বোধ করি রজনীকান্তকে নিয়ে। ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ এই গান দিয়ে যদি আমরা দ্বিজেন্দ্রলালকে চিনি, ‘মোদের গরব মোদের আশা/ আ-মরি বাংলা ভাষা’ যদি হয় অতুলপ্রসাদের পরিচয়, তাহলে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই; দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই’, এই একটি রচনাই কান্তকবির অমরত্বের জন্য যথেষ্ট।
রজনীকান্তের নিজের লেখা ডায়েরি ও মেয়ে শান্তিদেবীর লেখায় তিনি মোটামুটি উঠে এসেছেন। কিছু গবেষণামূলক বইও রয়েছে, যেমন দেবাশীষ ভৌমিকের লেখা ‘রজনীকান্ত সেন’, সুধীর চক্রবর্তীর ‘দ্বিধাহীন অনুভূতির চারণ: রজনীকান্ত সেন’, গৌরী ভট্টাচার্যের ‘রজনীকান্ত সেন ও তাঁর গান’, আসাদ চৌধুরীর ‘রজনীকান্ত সেন’, মোহাম্মদ জুলফিকারের ‘সাধক-কবি রজনীকান্ত সেন’। এর মধ্যে কিছু বই দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। এসব বই ও পত্রপত্রিকার বিভিন্ন লেখা থেকে তাঁর জীবনের স্বরলিপি কিছুটা বোঝা যায়।
রবীন্দ্র-নজরুলের বাইরে অন্য তিন কবির মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের সংখ্যা ৫০০। অতুলপ্রসাদ লিখেছেন ২০০-র বেশি গান। অপর দিকে রজনীকান্তের গানের সংখ্যা ২৯০। বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায়, রজনীকান্ত গান লিখে উদাসীনভাবে ফেলে রাখতেন। কিন্তু গাওয়ার সময় আর সেগুলো খুঁজে পেতেন না। স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী সেগুলো কুড়িয়ে এনে যথাসম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা করতেন।
ঝড়ের বেগে গান রচনা করতে পারতেন রজনীকান্ত। বলা হয়ে থাকে, তাঁর বেশির ভাগ রচনাই অতি অল্প সময়ে রচিত। সাংবাদিক ও লেখক জলধর সেন জানাচ্ছেন এ রকমই একটি ঘটনা। একবার রাজশাহী গ্রন্থাগারে একটি সভার আয়োজন করা হয়। বিকেল চারটায় সভা শুরু হবে। তখন বাজে তিনটা। হঠাৎ রজনীকান্তকে অনুরোধ করা হলো একটি গান লিখতে। বন্ধু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ই অনুরোধটা করেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ এক কোনায় গিয়ে লিখে ফেললেন কয়েকটি চরণ-‘তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরনী সরসা, ঊর্ধ্বে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা, সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা।’ পরে যেটি হয়ে ওঠে অসাধারণ একটি দেশাত্মবোধক গান।
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ লেখার ইতিহাসও তা-ই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলো। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন এক বঙ্গদেশ। ঢাকাকেন্দ্রিক মানুষেরা এই সিদ্ধান্তে আপ্লুত। আবার কলকাতাকেন্দ্রিক অনেকে অখুশি। তাঁরা শুরু করলেন প্রবল আন্দোলন। বর্জন করলেন ইংরেজদের পণ্য। এই সময় আন্দোলনরত তরুণেরা, বলা যেতে পারে রজনীকান্তকে দিয়ে গানটি লিখিয়ে নেন। ইতিহাস যা-ই হোক, গানটি স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার এক জাগরণী গান, সর্বকালের জন্য প্রাসঙ্গিক।
মূলত ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও স্বদেশ প্রেরণামূলক গানই বেশি লিখেছেন রজনীকান্ত। তাঁর আরও যেসব গান রয়েছে, এর মধ্যে বেশি গাওয়া হয়, ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে।’ এ ছাড়া রয়েছে, ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি।’
কেবল গান কেন, কবিতাও তিনি কম লেখেননি। আমাদের ছোটবেলায় পড়া যেসব কবিতা, যেমন ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/ “কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?”’ ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামে কবিতাটি তাঁরই লেখা। ‘শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে, জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে’ কিংবা ‘নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান’— এই সবই তাঁর লেখা।
রজনীকান্তের জীবন যখন শেষ সময়ে এসে পড়েছে, হাসপাতালে বসে মৃত্যুর প্রার্থনা করছেন, তখন একবার রবীন্দ্রনাথকে দেখার সাধ হয় তাঁর। খবর পেয়ে আসেন কবিগুরু। সেদিন রজনীকান্তের শয্যাপাশে বসে রবীন্দ্রনাথ নিজে হারমোনিয়াম বাজান আর গান করেন রজনীর দুই সন্তান। সেদিন তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘বেলা যে ফুরায়ে যায়, খেলা কি ভাঙে না হায়।’ চলে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ‘আমায় আশীর্বাদ করুন, দয়াল শীঘ্র আমাকে তার কোলে নিয়ে যান।’
প্রয়াণ দিবসে আমরা এই মহান গীতিকবিকে স্মরণ করি, তাঁকে চর্চা করি। কারণ, তাঁরাই আমাদের আদি মহান মানুষ।