লিওনার্দ কোহেন। রয়টার্স ফাইল ছবি
লিওনার্দ কোহেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

৯০–এ কোহেন, বিষণ্নতার বাঁশিওয়ালার জন্মদিন আজ

ইংল্যান্ডের এক দ্বীপ। পাঁচ দিন ধরে চলা সংগীত উৎসবের শেষ রাত। খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়েছেন লাখ পাঁচেক মানুষ। অপেক্ষা করছেন, কখন আসবেন প্রিয় গায়ক। বিরক্তির পারদ যখন চরমে, ভোররাত চারটায় মঞ্চে উঠলেন তিনি। গিটারে সুর তুললেন সেই গান, ‘দে উইল নেভার, এভার রিচ দ্য মুন’। বিষাদমাখা সুর ছড়িয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। গানে গানে বিষণ্নতার গল্প তাঁর মতো আর কেই–বা গাইতে পারত! সেই গায়ক লিওনার্দ কোহেনের জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে আজ ৯০ বছরে পা দিতেন এই কানাডীয় গায়ক। কেবল কি গায়ক? কবি, গীতিকবি, ঔপন্যাসিক; অনেক পরিচয়েই চেনানো যায় তাঁকে। তবে বিশ্বজুড়ে ভক্তদের কাছে তিনি বিষণ্নতার বাঁশিওয়ালা, সামান্য কিছু বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে যিনি বিষাদগাথা ছড়িয়ে দিতেন।

১৯৩৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কানাডার কুইবেকের ওয়েস্টমাউন্টে জন্ম কোহেনের। কিশোর বয়সেই গিটার বাজানো শিখে তৈরি করেন লোকসংগীতের দল ‘বাকস্কিন বয়েজ’। স্প্যানিশ লেখক ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সংস্পর্শে এসে কবিতা ভালোবেসে ফেলেন। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পর প্রকাশ করেন প্রথম কবিতার সংকলন ও দুটি উপন্যাস।

লিওনার্দ কোহেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

কাপড়ের কারখানায় কাজ আর বই বিক্রি না হওয়ায় হতাশায় ১৯৬৬ সালে মন্ট্রিয়ল ছেড়ে নিউইয়র্ক পাড়ি দেন কোহেন। আলাপ হয় লোকসংগীত গায়ক জুডি কলিনসের সঙ্গে। নিজের অ্যালবাম ‘ইন মাই লাইফ’–এ কোহেনের লেখা দুটি গান সংযোজন করেন কলিনস। এ দুটির মধ্যেই ছিল কোহেনের প্রথম সাড়াজাগানো গান ‘সুজানে’। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘সংস অব লিওনার্দ কোহেন’ অ্যালবাম।

বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। জেমস টেলর, উইলি নেলসনের মতো শিল্পীদের প্রিয় হয়ে ওঠেন কোহেন। অ্যালবামের সাদা-কালো ছবি তৈরি করে কোহেনের সিগনেচার স্টাইল। প্রকাশিত হয় ‘সংস ফ্রম আ রুম’ (১৯৬৯) ও ‘সংস অব লাভ অ্যান্ড হেট’ (১৯৭১) অ্যালবাম। সত্তরের দশকে শুরু করেন মিউজিক ট্যুর। ১৯৭১ সালে রোলিং স্টোনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে মিশতেই আমি ট্যুর করছি।’
লোকগান দিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন সংগীতের ক্যারিয়ার। সত্তরের দশকে তিনিই চলে এলেন পপ গানের জগতে। তাঁর গান ধর্ম, একাকিত্ব, যৌনতা, মানুষে মানুষে জটিল সম্পর্ক উঠে এসেছে বারবার।

লিওনার্দ কোহেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

১৯৭৭ সালে ‘ডেথ অব আ লেডিস ম্যান’, ১৯৭৯ সালে ‘রিসেন্ট সংস’ নামে দুটি অ্যালবাম বের হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে ‘ভ্যারিয়াস পজিশনস’ অ্যালবামটি বের হয়। এ অ্যালবামেই ছিল তাঁর বিখ্যাত ‘হাল্লেলুইয়া’, ‘দ্য ল’, ‘ইফ অ্যাট বি ইয়োর উইল’ গানগুলো। ‘আই অ্যাম ইয়োর ম্যান’ অ্যালবাম বের হওয়ার পর দেখা গেল তাঁর গান গাওয়ার ধরন বদলে গেছে। গান হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবন নিয়ে সমালোচনামুখর। এ অ্যালবামের ‘ফার্স্ট উই টেক ম্যানহাটন’, ‘এভরিবডি নোজ’ গান দুটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের মাউন্ট বালডি জেন সেন্টারে। সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে তিনি মৌনতা ভাঙেন। ‘টেন নিউ সংস’ অ্যালবামটি বের হয় এরপর। ম্যানেজার কেলি লিঞ্চ এ সময় তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেন। এই ক্ষতিপূরণের জন্য ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ৩৮৭টি শো করেছেন। ‘ওল্ড আইডিয়াস’ নামে আরেকটি অ্যালবাম বের হয় ২০১২ সালে। ‘পপুলার প্রবলেমস’ বের হয় গায়কের আশিতম জন্মদিনে।
২০১৩ সালের শেষ মাসে তিনি একটি গ্র্যান্ড ট্যুরের পর আর জনসমক্ষে আসেননি।

২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ছেলে অ্যাডামের প্রযোজনায় বের করেন ‘ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার’। শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাড়ির বাইরে বের হতে পারতেন না কোহেন। ডাইনিং টেবিলে বসেই মাইক্রোফোনের সাহায্যে ল্যাপটপে রেকর্ড করতেন তিনি। শেষ অ্যালবামেও বিস্ময়কর সাড়া পাওয়ার পর কোহেন বলেন, ‘আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আশা করছি খুব একটা কষ্ট হবে না।’
২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা যান, ১০ নভেম্বর তা ঘোষণা করা হয়।