সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী তাসরিফ খান। তরুণ এই গায়কের ক্যারিয়ার শুরুটা মসৃণ ছিল না। নানাজনের নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে, অবহেলা সইতে হয়েছে। সেই সময় সবই নীরবে সহ্য করেছেন কুঁড়েঘর ব্যান্ডের এই প্রধান ভোকাল।
এই গায়কের ক্যারিয়ারের শুরুতে এমন তিনটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছিল, যা তাঁকে কখনো কাঁদিয়েছে, কখনো ভাবিয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনাগুলো থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ভক্তদের কাছে তিনি আজকের তাসরিফ খান।
২০১৬ সালের ঘটনা। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন তাসরিফ। তখন বেশির ভাগ সময় গান নিয়েই কাটত। এমন সময়ে সুযোগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আয়োজনে গান করার। সেখানে আরও বেশ কটি ব্যান্ড গান করবে। খবরটি শুনে বেশ খুশি হয়েছিলেন তাসরিফ। চলে গেলেন নিউমার্কেটে শপিং করতে। কেনাকাটার পর অনেক সময় নিয়ে অনুশীলন করলেন। বিকেলে গান করার কথা ছিল। সেভাবেই হাজির হন। কিন্তু সেদিন অন্য ব্যান্ডের কারণে গান করা হলো না। আয়োজকদের কাছ থেকে শুনতে হলো আরেকটু পরে সুযোগ পাবেন।
সাত বছর আগের সেই স্মৃতি স্মরণ করে তাসরিফ বলেন, ‘সেদিন ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। অনেক সময় অপেক্ষা করেছিলাম। আমার ক্লাসমেটরা অনেকেই ছিল, তারা বারবার জানতে চাইছিল কখন আমরা গান করব। তাদের বলেছি, “দেরি হবে। তবে গান করব।” সবাইকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। পরে যখন আমাদের সময় এল, মঞ্চে উঠি। তখন আয়োজকেরা বললেন, “এখন ডিজে পার্টি হবে। তোরা নেমে যা। এখন আর কোনো গান হবে না। তোরা তো এমন কোনো শিল্পী হস নাই, তোদের গান করতেই হবে।” অপমান করেই আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল। দিনটা আমার জন্য খুবই কষ্টের ছিল। খুব মন খারাপ হয়েছিল। এখনো দিনটা ভুলতে পারি না।’
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের এই দিনগুলো চাইলেও ভুলতে পারেন না তাসরিফ। এমন আরও দুটি ঘটনা তাঁকে সব সময় মনে করিয়ে দেয়, আরও এগিয়ে যেতে হবে। আরও ভালো করতে হবে। তখন পেশাগতভাবে ব্যান্ড দল গঠন নিয়ে কাজ করছেন। দাঁড় করিয়েছেন কুঁড়েঘর ব্যান্ড দল। সেই সময়ে রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরতে গিয়েছিলেন তাঁরা। গিয়ে দেখতে পান, সেখানে শীতার্ত মানুষদের সহায়তার জন্য গান হচ্ছে। সেদিন যাঁরা গান গাইছিলেন, তাঁদের পাশে ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসেন তাসরিফ। তাঁদের গানের সঙ্গে তাল মেলাতে থাকেন। একসময় সেই গায়কেরা কিছুটা বিরতি নেন। সেই সুযোগে অনুমতি নিয়ে একটি গান করেন তাসরিফ। গানটি ছিল ‘সাত রাজার ধন...’।
তাসরিফ সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে লিখেছেন, ‘আমি চোখ বন্ধ করে গানটি গাইছিলাম। চোখ খুলে দেখি, অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছেন। গান শুনছেন। পরে আরেকটা গান করতে যাব, তখন আমার গিটারের তার ছিঁড়ে যায়। পাশেই যাঁরা গিটার বাজাচ্ছিলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে গিটার নিতে চাই। কিন্তু যাঁর গিটার, তিনি হঠাৎ বললেন, “এটা অনেক দামি গিটার। ধরার মতো যোগ্যতা এখনো তোমার হয়নি।” এমন অপমানজনক কথা শুনে সেদিন মনটা একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। ঘটনার পর সেদিন ধানমন্ডি লেকের এক পাশে বসে অঝোরে কান্না করেছিলাম।’
ক্যারিয়ারে এগিয়ে আসার পেছনে ঘটনাগুলো তাঁকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছে। এখান থেকে পেয়েছেন শক্তি। তাঁকে গান করতে হবে। দর্শক যেন তাঁর গান পছন্দ করেন, সেই জায়গায় যেতে হবে। গান দিয়েই কিছু একটা করতে হবে—এটা সব সময় তাঁর মাথায় থেকেছে। যে কারণে কোনো অপমানই তিনি গায়ে মাখেননি।
আরেক দিনের ঘটনা। পরবর্তী ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না এই গায়ক। কারণ, তিনি সব সময় শুনেছেন, সৃষ্টিশীল মানুষেরা নরম মনের হন। এমন একজন তাসরিফকে অপমান করলেন। সে কথা বলতে গিয়েও মন খারাপ হয়ে এল এই সংগীতশিল্পীর। তিন বছর ধরে নিজেই গান লেখেন তাসরিফ। সেই গান কীভাবে রেকর্ডিং করবেন, সেটা নিয়ে তেমন কোনো ধারণাই ছিল না। কীভাবে মিউজিক করে, ভোকাল দেয়—এগুলো জানতেন না। তাসরিফের ইচ্ছা একটি গান রেকর্ডিং করার। এক বন্ধুর কাছ থেকে একজন নামকরা কম্পোজারের মুঠোফোন নম্বর জোগাড় করেন। তাঁকে সব খুলে বলেন। সব শুনে আট বছর আগে সেই মিউজিক কম্পোজার ৪০ হাজার টাকা চান। ওই সময়ে তাসরিফের কাছে এই অর্থ মানে পাহাড়সমান টাকা। গিটার বিক্রি ও পরিবারের থেকে সাকল্যে ১০ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবেন। সেই অর্থ দিয়ে কম আয়োজনে গানটি করে দিতে বলেন। এর উত্তরে তাসরিফ সেদিনও চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
এই গায়ক বলেন, ‘তিনি খুবই বাজেভাবে আমাকে বলেন, “আমার স্টুডিওতে পা ফেললেও ২০ হাজার টাকা লাগে।” তিনি অপমান করেন। তখন ভাবি, আর কত ছোট হব। নিজেরা যা পারি, সেভাবেই গান করব। তখন ইউটিউব খুলি। তাসরিফ খান নামে। পরে সেটা কুঁড়েঘর ব্যান্ডের নামে দিয়ে দিই। সেখানে এখন কোটি কোটি ভিউ। দর্শক গান দেখছেন, পছন্দ করছেন। আমরা নিয়মিত দেশ-বিদেশে কনসার্টে গান করছি। কিন্তু ক্যারিয়ার শুরুর আগে তিনটি ঘটনা আমাকে খুবই নাড়া দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সাহস জুগিয়েছে। এটা কখনোই ভুলব না।’
শৈশব থেকেই তাসরিফের গানের চর্চা শুরু। কিছুটা বড় হওয়ার পর মন চাইত ভালো একটি গিটার কিনতে; কিন্তু সেই অর্থ ছিল না। ছিল না ভালো এক জোড়া জুতা কেনার মতো অর্থ। কখনো প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত জামাকাপড় ব্যবহারের সুযোগ পাননি। কিন্তু অপেক্ষায় ছিলেন কোনো একদিন জীবনটা বদলে যাবে। তখন আর অর্থ কোনো বাধা হবে না। ক্যারিয়ারে গান নিয়েই সেই পথে হেঁটে চলেছেন এই গায়ক।
তাসরিফ বলেন, ‘শৈশব থেকেই অনেক আফসোস নিয়ে বেড়ে ওঠা। কিন্তু অপেক্ষা করেছি, যখন সুযোগ হবে, তখন নিজের শখ পূরণ করব। এখন নিজের শখ পূরণ করতে পারি গান গেয়ে, এটাই বড় প্রাপ্তি। আর আমাদের কারও প্রতি কোনো অভিমান নেই। আমরা ভক্তদের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’
তাসরিফের গানে আসার ঘটনাও বেশ মজার। শৈশবে তিনি খুব লাজুক ছিলেন। অন্যের সামনে গান করতে লজ্জা পেতেন। তিনিই একদিন ‘নিধুয়া পাথারে...’ শিরোনামে একটি গান মুঠোফোনে রেকর্ড করেন। ভয়ে ভয়ে ফেসবুকে গানটি পোস্ট করেন। সেই গানে ৯০ জন ইতিবাচক মন্তব্য করেন। সেদিনই তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি গান করলে ৯০ ভাগ না হলেও ৫০ ভাগ মানুষ তো তাঁর গান পছন্দ করবেন। এই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে গানে ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করে।
তাসরিফের গাওয়া প্রথম ‘মধ্যবিত্ত...’ গানটি রাতারাতি তাঁকে শ্রোতাদের কাছে নিয়ে যায়। অল্প সময়ে গানটি আড়াই লাখবার শেয়ার হয়। গানটিতে মধ্যবিত্তদের মনের কথা ফুটে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ‘তুমি মানে আমি...’, ‘ময়না রে...’, ‘তাই তো আইলাম সাগরে...’, ‘ব্যাচেলর...’ গানগুলো আলোচনায় আনে।
তাসরিফ বলেন, ‘“তাই তো আইলাম সাগরে...” আমাদের ব্যান্ডের টার্নিং পয়েন্ট। গানটির ভিউ প্রায় ৮২ মিলিয়ন। এবার আমরা পরিকল্পনা করছি, “তাই তো আইলাম সাগরে...” গানটির অফিশিয়ালি মিউজিক ভিডিও নিয়ে আসব। আগে মোবাইল দিয়ে শুটিং করেছিলাম। এখন একদমই প্রফেশনালি গানটি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসছি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে গানটি পাবেন ভক্তরা।’