পপসম্রাট আজম খানের কাছে গান কেবল আনন্দ-বিনোদন নয়, ছিল একজন যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধার কাব্যগাথাও। সময়ের সাহসী এ মানুষটি যুদ্ধের হাতিয়ার স্টেনগান রেখে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন সমাজ সচেতনতার গান। চারপাশের সব প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে শুরু করেছিলেন গানের নতুন ধারা। ৫ জুন আজম খানের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের আজকের দিনে প্রয়াত হন গায়ক।
‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, ‘অভিমানী’, ‘অনামিকা’, ‘পাপড়ি’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘ও চাঁদ সুন্দর’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘জীবনে কিছু পাব না রে’, ‘বাধা দিও না’সহ বহু গান আজম খানের কণ্ঠে শুনেছে মানুষ।
বাংলাদেশি সংগীতে আজম খান ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন সরল-সহজ সাদামাটা, অন্যদিকে তিনি ছিলেন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ঘাটতি ছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সাহসী যোদ্ধা আজম খানের গানের মধ্যে। মানুষের সংকটের সময়ে আজম খান গানে গানে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা বলেছেন। সংগ্রাম ও ভালোবাসায় তাঁর নতুন ধরনের পরিবেশনায় সেদিন জেগে ওঠেন তরুণেরা।
এ বিষয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলা গান নিয়ে এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের বাংলা গানের ইতিহাস যাঁরা লিখবেন, তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের একটা ঘটনার কথা তাঁরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না, বিশেষ করে একজন গায়কের কথা। তাঁর নাম আজম খান। কোনো অসাধারণ গায়ক নন আজম খান। কিন্তু এমন এক ধরনের গান তিনি সেকালে আমাদের শুনিয়েছিলেন, যে গান এ দেশে এর আগে কেউ শোনেনি। গানগুলোর কথা, সুর, সঙ্গে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পরিবেশনের রীতি—সবই ছিল আলাদা।’
আজম খানের দীর্ঘদিনের বন্ধু ফকির আলমগীর প্রয়াত হয়েছেন তিন বছর হতে চলল। তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে বলেছিলেন, ‘আজম খান ছিল ব্যতিক্রম, ভিন্নধর্মী। বাংলা গান বা সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যখন আমি, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজসহ অনেকে যুক্ত হলাম, তখন বাংলা গানের দৃশ্যপট পাল্টে গেল। দেশের তরুণসমাজ আমাদের গানে মেতে উঠল। উন্মাতাল তরুণ-তরুণী জড়ো হতে লাগল আমাদের সময়ের কনসার্টে। নতুন গানের ঝাঁজ আর উত্তেজনার জ্বলন্ত উন্মাদনা যেন ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দেয় আমাদের যুগ–যুগান্তর উপেক্ষিত ও অবদমিত তারুণ্যের উদ্যম আকুতিকে। তবে গানের ভুবনের বিস্ময়কর জাদুকর আজম খান বরাবরই ছিল সরল-সহজ অতিসাধারণ। জীবনে তাঁর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না, গানই ছিল তার প্রাণ। কোনো অহংকার ছিল না তার। সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। মানুষের কাছে তার সাধারণ জীবনযাপন অসাধারণ করে তুলেছিল।’
আজম খানের জন্ম ঢাকার আজিমপুরে ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। তবে বেড়ে ওঠেন কমলাপুরে। ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, নিজামুল হক, মনিরুল আলম মনু ভাইয়ের নেতৃত্বে আজম খান ও তাঁর বন্ধু ফকির আলমগীর ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীতে যোগ দেন। গণ-অভ্যুত্থানের পল্টন থেকে লালদীঘি ময়দান তথা গোটা বাংলাদেশে গণসংগীত পরিবেশন করেন তাঁরা দুজন। দুই বন্ধু কৃষক সমিতির লাল টুপি মাথায় দিয়ে টঙ্গী, সন্তোষ, সাহাপুর, মাওলানা ভাসানীর কৃষক সম্মেলনেও অংশ নেন।
পপ সংগীতের অবিস্মরণীয় উত্থানের আগে আজম খান ও ফকির আলমগীর গণসংগীতের শিল্পী ছিলেন, ছিলেন সংগঠকও। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা দুই বন্ধু মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। আজম খান আগরতলা মেলাঘর আর ফকির আলমগীর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। দুজনই ফিরে এসে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দেশীয় সুরের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করেন আধুনিক এক ধারা। যার সঙ্গে যুক্ত হন ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, হাবলু, লাকী আখান্দ্, হ্যাপী আখান্দ্, পিলু মমতাজ প্রমুখ।
আজম খানরা দেশ স্বাধীন করার জন্য ছুটেছিলেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পেও চলত তাঁর গানের চর্চা। নতুন গান বাঁধতেন সেখানে। থালাবাসন ছিল বাদ্যযন্ত্র। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে আজম খানের গান শোনার জন্য ভিড় জমাতেন। সবার কাছে আজম খান পরিচিতি পেলেন গায়ক হিসেবে। পরে দেশ স্বাধীন করে ফিরেছিলেন আজম খান। তারপর শুরু হলো সংগীতচর্চা। শুনতেন বিটলস, দ্য শ্যাডোজ, রোলিং স্টোনের গানগুলো। একসময় বন্ধুদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেন। সেই অনুষ্ঠানগুলোতে পপ গান গাইতেন তাঁরা। আজম খানের গানের ভক্ত জুটে যায় পাড়া-মহল্লায়। তারপর সারা দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ সংগীতাঙ্গনে আলোড়ন তৈরি করে। ১৯৭২ সালে বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামসে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে অনুষ্ঠান শুরু করেন। ওই বছরই তাঁর ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি বিটিভিতে প্রচার হয়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। পরবর্তী সময়ে বিটিভিতে ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ গান গেয়ে হইচই ফেলে দেন আজম।
‘এক যুগ’ নামে তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। সব মিলিয়ে তাঁর গানের অ্যালবাম ১৭টি। গানের ভুবনের বাইরে খেলাধুলার প্রতিও ছিল তাঁর দারুণ ভালোবাসা। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালে তিনি গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের পক্ষ হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন। গানের বাইরেও বেশ কয়েকটি আলোচিত কাজও করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে হিরামনের একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে এবং ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের নামভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। ২০০৩ সালে বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেলও হন। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তাঁকে। সর্বশেষ ২০১০ সালে একটি কোমল পানীয়র বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করেন।
বঞ্চিত মানুষের গান করতে শুরু করেন আজম খান। তাঁর গানে আসতে থাকে সচেতনতা, দেশপ্রেম, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়, তরুণদের উদ্বুদ্ধকরণ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চলতে থাকে তাঁর গান। আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২০১১ সালের ৫ জুন মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে থেমে যায় তাঁর লড়াই। সশরীর না থাকলেও তাঁর গানগুলো আজও সমসাময়িক। এ গানই তাঁকে যুগ যুগ ধরে শ্রোতার মনে বাঁচিয়ে রাখবে।