সাদি মহম্মদ, একাধারে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, শিক্ষক। গানের জগতের একজন মহাতারকা। প্রিয় মা-বোন চলে যাওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সেই মনঃকষ্ট তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে মনমতো স্বীকৃতি না পাওয়া। প্রায়ই পরিবারের কাছে আক্ষেপ করতেন, কষ্টের কথা বলতেন। একটা সময় পুরোপুরিই বিষণ্নতায় ডুবে গিয়েছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন শিবলী মহম্মদ। বলতে পারছিলেন না, তবু প্রিয় বড় ভাইয়ের না পাওয়ার গল্পগুলো বলে গেছেন অবলীলায়।
বড় ভাইয়ের চলে যাওয়ার মুহূর্তটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ভাই শিবলী মহম্মদ। বলেন, ‘আমার ভাইয়ের অনেক অভিমান ছিল। ও মনে করত, তাকে মূল্যায়ন করেনি। আমরা বোঝাতাম, তোমাকে হাজার কোটি লোক ভালোবাসে। তোমার গান ভালোবাসে। এটাই তো তোমার জন্যে অনেক বড় পাওয়া।
কী হবে এত পদক, এ তো কিছু মানুষ পায়। আমার ভাইকে নিয়ে কখনো কেউ ভাবে না। এটা নিয়ে ওর মনে অনেক কষ্ট ছিল। বারবারই বলত, মা চলে গেছে আমি আর থাকব না। খালি বলত, আমার আর ভালো লাগে না। এটা আমিও বলি, আমার আর ভালো লাগে না; কারণ, মা ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু ছিল না। বোন চলে গেল, মা চলে গেল। ওর অনেক সময় অভিমান এটা হয়নি, ওটা হয়নি। বোঝাতাম, দরকার নেই। আমরা তো প্রাপ্তির জন্য কাজ করি না। ভালোবেসে আমরা কাজ করি। ছাত্ররা আমাদের সন্তান। তাদের দেখলে আমাদের আনন্দ হয়। আজকে গুরু চলে গেছে। সারা বিশ্বে তাঁর শিষ্য। এটা কি বেঁচে থাকা নয়? অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ভেতরে চাপা কষ্ট।’
শিবলী বলেন, ‘আমরা এত ক্লোজ! আমরা প্রতিটা রাতে সিনেমা দেখতাম, একটু গান শুনতাম। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, হেমন্তর গান শুনি। এগুলোই আমাদের আনন্দ দিত। বলতাম, আমরা বড্ড সেকেলে। একালের কিছু ভালো লাগে না। একটাই সমস্যা ছিল, বড্ড অভিমানী সে। রাষ্ট্রীয় কিছু স্বীকৃতি পেলে ওর তৃপ্তি হতো। কারণ, এটা (গান) নিয়েই ছিল ওর জগৎ। সেটা পায়নি। আমরা দুই ভাই বলতাম, মৃত্যুর পর যদি আমাদের কোনো সম্মান দিতে চায়, আমরা সেটা গ্রহণ করব না। কারণ, ওটা পাওয়ার কোনো আনন্দই তো নেই। আমার একুশে পদক মা দেখে যেতে পারলেন না। সাদি মহম্মদ তো আমার বড়। আমি তার সামনে একুশে পদক নিতে যাই, সেটা আমার জন্য কতটা বিব্রতকর! কত লজ্জা হয়েছে যেতে। আমি এমনও বলেছি, ভাই আমি নেব না। বলেছেন, না কেন তুই নিবি না, তুই তো নাচের জন্য বাংলাদেশে কম করিসনি। আমি বললাম, তুমি তো গানের জন্য, রবীন্দ্রসংগীতের জন্যে কম করোনি। ভাই বললেন, ঠিক আছে, তুই নে, তুই পেলেই আমি খুশি। অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য কার্ড দিলাম। বলেছেন, থাকরে তুই যা আমি অনেক খুশি, মনে কিছু নিস না, তুই যা। কিন্তু আমি ওখানে গেলে লোকে প্রশ্ন করবে, আপনাকে কেন দেয়নি? আমি ওটা নিতে পারব না।’
ভাইয়ের মৃত্যুর শেষ মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিবলী বলেন, ‘কত সুন্দর পরিবেশ করে ডিমলাইট জ্বালিয়ে হারমোনিয়াম দিয়ে গেয়েছে। ইলেকট্রিক তানপুরায় রেওয়াজ করল। দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। তার মাথায় সেটাই (আত্মহত্যা) ছিল। যে ছেলেটা পাহারায় থাকত তাকে বলেছিল, যাও বাবু, রেওয়াজ শেষ হলে আমি তোমাকে ডেকে নেব। আমি তখন মাত্র বাসায় এসেছি। দেখি দরজা বন্ধ। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি, দরজা বন্ধ কেন? সে বলল, রেওয়াজ শেষ হলে ডাকবে বলেছে। আমি বললাম, না, বন্ধ করে রেওয়াজ করবে না! গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম, খোলে না। তারপর দ্রুত দরজা ভেঙে দেখি সব শেষ…।’